ভারত শাসিত কাশ্মীরে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বেসামরিক মানুষ হত্যার ঘটনা ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি করেছে; বিশেষ করে এই অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে। এর জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দায়ী করা হচ্ছে ভারতকে। সূত্র মতে, কাশ্মীরে ৮০০র বেশি হিন্দু পরিবার বসবাস করে। নব্বইয়ের দশকে এই এলাকায় সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর যখন হাজার হাজার হিন্দু পরিবার ভারতের অন্যান্য এলাকায় চলে যায়, তখনও তারা এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
ভারত থেকে স্বাধীনতা চাওয়া বিদ্রোহী সদস্যরা অনেক সময় এই সংখ্যালঘু হিন্দুদের টার্গেট করে হামলা করে। কারণ তাদের অভিযোগ, এরা নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা করছে।
গত সপ্তাহে এখানকার একটি স্কুলে হামলা করেছিল বন্দুকধারীরা। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা নিশ্চিত করেছেন যে, তারা সকল কর্মীকে হাজির করে পরিচয়পত্র দেখতে চায়। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রিন্সিপ্যাল এবং একজন শিক্ষককে আলাদা করে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গত দুই দশকে এরকম আরো অনেক নিহত হওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিত ও শিখরা ছিলেন। ২০০০ সালের মার্চ মাসে অজ্ঞাতনামা হামলাকারীরা একটি গ্রামে হামলা করে ৩৫ জন শিখকে হত্যা করে। ২০০৩ সালে পুলওয়ামা জেলায় একটি গ্রামে হামলা করে ২০ জনের বেশি কাশ্মীরি পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়েছিল।
গত এক সপ্তাহেই কাশ্মীরে এরকম সাতটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা ঘটছে এমন সময় যখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ৭০ জন মন্ত্রী কাশ্মীর পরিদর্শন করে গেছেন। সংবিধান থেকে কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধার আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল করায় কী সুবিধা হয়েছে, সেটা তুলে ধরাই ছিল এই মন্ত্রীদের কাজ।
কাশ্মীরের পুলিশ প্রধান বিজয় কুমার বলেছেন, শুধুমাত্র এই বছরে কমপক্ষে ২৮ জন বেসামরিক নাগরিককে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা হত্যা করেছে। এই ২৮ জনের মধ্যে পাঁচ জন হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের, দুইজন অস্থানীয় শ্রমিক।
যদিও নিহতদের বেশিরভাগ মুসলমান, কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ধর্মীয় উত্তেজনা ও ভীতির বিষয়টিও বেরিয়ে এসেছে। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের মহাপরিচালক দিলবাগ সিং বলেছেন, ”এটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার একটা চেষ্টা।”
এত সংঘাত-সহিংসতা কেন?
ভারত শাসিত কাশ্মীরের অনেকেই চায় না যে এলাকাটি ভারতের শাসনে থাকুক। তারা চায়, হয় পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তি। প্রসঙ্গত, ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি মুসলিম। এটিই হচ্ছে ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এখানে বেকারত্বের হার অত্যন্ত উঁচু, তা ছাড়া রাস্তায় বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহীদের দমনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নীতি পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছে।
কাশ্মীরে বিদ্রোহী তৎপরতা বড় আকারে শুরু হয় ১৯৮৭ সালে বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের পর জেকেএলএফ নামে সংগঠনের উত্থানের মধ্যে দিয়ে। ভারত অভিযোগ করে, পাকিস্তান সীমান্তের ওপার থেকে যোদ্ধাদের পাঠাচ্ছে; তবে পাকিস্তান তা অস্বীকার করে।
এই রাজ্যে ১৯৮৯ সালের পর থেকে সহিংস বিদ্রোহ নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে গেছে। তবে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ২২ বছর বয়স্ক জঙ্গী নেতা বুরহান ওয়ানি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে এক লড়াইয়ে নিহত হবার পর থেকে পুরো উপত্যকায় ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
বুরহান ওয়ানি সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন এবং এতে তার প্রকাশ করা বিভিন্ন ভিডিও তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। মনে করা হয়, এ অঞ্চলে জঙ্গী তৎপরতা পুনরুজ্জীবিত করা এবং তাকে একটা ‘ন্যায়সঙ্গত ইমেজ’ দেয়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
রাজধানী শ্রীনগরের ২৫ মাইল দূরের ট্রাল শহরে বুরহান ওয়ানির শেষকৃত্যে সমাগম হয়েছিল হাজার হাজার লোকের। জানাজার পর শুরু হয় সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষ, কয়েকদিনব্যাপী সহিংসতায় নিহত হয় ৩০ জনেরও বেশি বেসামরিক লোক।
এর পর থেকেই রাজ্যটিতে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা চলছে। ২০১৮ সালে বেসামরিক লোক, নিরাপত্তা বাহিনী এবং জঙ্গী মিলে মোট নিহত হয় ৫০০ জনেরও বেশি; যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
এদিকে, ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে আত্মঘাতী হামলায় চল্লিশজনেরও বেশি ভারতীয় আধা-সেনা নিহত হওয়ার পর এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে কাশ্মীরীদের ওপর হামলা ও চড়াও হবার খবর পাওয়া যায়।
দেশটির দেরাদুনের বিভিন্ন কলেজ-পড়ুয়া কাশ্মীরী ছাত্রছাত্রীদের উত্তেজিত জনতা যেমন ঘিরে ধরে, তেমনি বিহারের পাটনাতে কাশ্মীরি শাল-বিক্রেতাদের দোকানে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালানো হয়।
ওই সময় দিল্লির জেএনইউ-তে বামপন্থী ছাত্র নেত্রী ও কাশ্মীরের মেয়ে শেলা রশিদ টুইট করে জানান, ‘দেরাদুনে ডলফিন ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জনা-কুড়ি কাশ্মীরি ছাত্রী চরম বিপদে পড়েছেন। তাদেরকে টানা বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে তাদের হোস্টেলে আটকে রেখে বাইরে থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়েও তাদের উদ্ধার করতে পারছে না।’
পাকিস্তানের দাবি
গত সপ্তাহে ১০ নিরীহ কাশ্মিরিকে হত্যা করেছে ভারতীয় বাহিনী। এছাড়া সম্প্রতি ১৪০০ কাশ্মিরিকে আটকের অভিযোগ তুলে নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তান। সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আছিম ইফতিখার আহমেদ দাবি করেন, নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছেও হস্তান্তর করেনি তারা।
গত কয়েকদিন ধরে উত্তপ্ত ভারত অধিকৃত কাশ্মির। উপত্যাকায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনার দাবি করে আসছে ভারতীয় বাহিনী। ভারতীয় বাহিনীদের সঙ্গে গোলাগুলিরও খবর পাওয়া গেছে। এতে বেশ কয়েকজন অস্ত্রধারী প্রাণ হারিয়েছেন।
যদিও এ নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘শুধু গত সপ্তাহেই ভুয়া এনকাউন্টার ও তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে ভারতীয় বাহিনী। এতে বেশ কয়েকজন কাশ্মিরি শহীদ হন। ভিত্তিহীন অভিযোগে অনেককে ধরে নিয়ে কারাগারে বন্দি করেছে’।
এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান পাকিস্তানের মুখপাত্র আছিম ইফতিখার। কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে উল্লেখ করে বিশ্ব সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে ইসলামাবাদ।
২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা ৩৭০ ধারা বাতিল করে মোদি সরকার। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় উপত্যাকার বাসিন্দারা। তাদের দমাতে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে ১০ লাখের মতো সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করে দেশটির সরকার।
কাশ্মীরে ভারতের হত্যার ইতিহাস
১৯৪৭-এ কাশ্মীরের নিরীহ মুসলিমদের ওপর গণহত্যায় চালিয়েছিল ভারতীয় বাহিনী। গত বছর বর্বর সেই হামলায় ২ লাখ ৫০ হাজার মুসলিম নিহত হন বলে দাবি করেন পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট সরদার মাসুদ খান।
তিনি ওই সময় বলেন, গত ৭৩ বছরে ভারতীয় সেনা কর্তৃক হত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, চোখ তুলে ফেলাসহ অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কাশ্মীরের অর্ধ লাখ মুসলমান।
১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবরে ভারত কাশ্মীরের প্রবেশ করে বলে জানান তিনি। সেসময় পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে হরি সিং ভারতে যোগ দেবার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, এবং ভারতের সামরিক সহায়তা পান। পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ; যা চলে প্রায় দু’বছর।
ভারতীয় বাহিনী জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে পা রাখার পর থেকে ২৭ অক্টোবরের দিনটি পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাশ্মীরে ‘কালো দিন’ পালন করে আসছে। গেল বছর জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ‘৩৭০ ধারা’ রদ করে ভারত কেন্দ্রশাসিত সরকারের অধীনে চলে যায়। ওই ঘটনায় প্রতিবাদ জানালে বহু কাশ্মীরি নির্যাতনের শিকার হন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তখন সেনা মোতায়নের পরই কাশ্মীরের জনগণের ওপর বর্বর হামলা, গণহত্যা এবং মুসলিমবিরোধী মিথ্যা প্রচারণা চালায় ভারত। সেসময় ২ লাখ ৫০ হাজার মুসলমান হত্যা করে ভারতীয় বাহিনী। নির্যাতনের মুখে বহু কাশ্মীরি বাস্তুচ্যুত হন। একই সঙ্গে অনেককে পাকিস্তানে পুশ করা হয় বলেও দাবি করেন আজাদ কাশ্মীরের এই প্রেসিডেন্ট। বলেন, মূলত ২৭ অক্টোবর থেকেই কাশ্মীদের ওপর গণহত্যার অভিযানে নামে ভারত।
কাশ্মীরের জনগণ প্রথমে ডোগরা রাজবংশের স্বৈরাচারী শাসন থেকে এবং তারপরে ভারতীয় দখল থেকে স্বাধীনতা অর্জনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। মাসুদ খান বলেন ‘১৯৪৭ এ কাশ্মীরের জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লাহ ভারতে যোগ না দিতেন, আমরা কাশ্মীরিদের কয়েক দশক ধরে চলমান গণহত্যার হাত থেকে বাঁচাতে পারতাম।’ ওই এক ভুল কাশ্মীরিদের অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয় বলে মনে করেন তিনি।
তবে কাশ্মীরের অধিকার আদায়ে বিশ্ব এখন সোচ্চার বলেন জানান প্রেসিডেন্ট সরদার। মানবাধিকার সংস্থাগুলো ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। কাশ্মীরিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান সব সময় পাশে আছেন বলেও জানান তিনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫৬
আপনার মতামত জানানঃ