সাম্প্রতিক দশকগুলোতে লাখ লাখ মানুষ গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে চলে এসেছে। আর এ প্রবণতার কারণে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যার বাসস্থান হচ্ছে শহরাঞ্চল। যার ফলে ১৯৮০-এর দশক থেকে শহুরে তাপমাত্রা বেড়ে তিনগুণ হয়েছে-যা বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যাকে প্রভাবিত করে।
সম্প্রতি পিএনএএস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় আরও বলা হয়, এ সমস্যায় সবচেয়ে বেশি জর্জরিত শহর ঢাকা। মারাত্মক শহুরে তাপের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহর হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নাম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি সায়েন্সেন (পিএনএএস) জার্নালে এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণাটির শিরোনাম ‘গ্লোবাল আরবান পপুলেশন এক্সপোজার টু এক্সট্রিম হিট’।
গবেষণাটির প্রধান ও কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির পোস্ট ডক্টোরাল রিসার্চার কাসাকেইড তুহলসক বলেন, “এটার বিশাল প্রভাব হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এটি অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার বৃদ্ধি করে। এটি মানুষের কাজ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং এর ফলে অর্থনৈতিক উৎপাদন কম হয়। কারও স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপ হলে এটি সেই অবস্থাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।”
যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণার জন্য ১৯৮৩ সাল থেকে থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৩ হাজার শহরের ইনফ্রারেড স্যাটেলাইট চিত্র এবং দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও আদ্রতার রিডিংগুলো নিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। ওই ফলাফলের সঙ্গে সময় ব্যবধানে শহরের জনসংখ্যারকেও গণনায় নেন গবেষকরা।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, ১৯৮৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, ঢাকার জনসংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দিন হিসেবে ৫ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ এই চরম তাপ সহ্য করেছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির মধ্যে থাকা অন্যান্য শহরগুলির মধ্যে রয়েছে চীনের সাংহাই এবং গুয়াংজু, মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮০’র দশক থেকে মারাত্মক শহুরে তাপের সংস্পর্শ তিনগুণ হয়েছে এবং বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক –চতুর্থাংশ এর শিকার হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এই উদ্বেগজনক প্রবণতাকে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সংমিশ্রণে রেখেছেন এবং এর সম্ভাব্য মারাত্মক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০টি বড় শহরে তাপের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যার মধ্যে হিউস্টন, ডালাস-ফোর্ট ওয়ার্থ, টেক্সাসের সান আন্তোনিও এবং অস্টিন, ফ্লোরিডার পেনসাকোলা, নেভাদার লাস ভেগাস, ব্যাটন রুজ এবং লুইসিয়ানাতে লেক চার্লস এবং প্রভিডেন্স রোড আইল্যান্ড।
এর আগে ২০১৯ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, নগরীয় জনসংখ্যার তুলনায় শহরের অনুভূমিক বৃদ্ধির হার বিশ্বব্যাপী বার্ষিক ১ দশমিক ৬৪ গুণ অর্থাৎ দ্রুতলয়ে বাড়ছে নগরের সীমা ও সংখ্যা, তবে সর্বাধিক বৃদ্ধির হার এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে। পৃথিবীতে মানুষই সম্ভবত একমাত্র জীব, যে তার নিজের কল্যাণের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের যেকোনো উপাদানকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন এমনকি নিঃশেষ করে দিতে একটুও পিছপা হয় না।
জলবায়ু পরিবর্তন ও অস্বাভাবিক নগরায়ণ বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করছে কিন্তু বিশ্বে নগরায়ণের প্রথম দিকে নগর জলবায়ুর অভিঘাতের বিষয়টি ছিল চরম উপেক্ষিত। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লুক হাওয়ার্ড ১৮২০ সালে লন্ডন শহরে নগর জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়টি প্রথম তুলে ধরলেও প্রায় শতাধিক বছর পরে অর্থাৎ ১৯৩৫ সালের দিকে নগর জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা নতুন মাত্রা পায়। এক সময় নগরীয় উষ্ণতা মধ্য অক্ষাংশের সমস্যা হলেও বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৫ হাজারটি বড় ও মাঝারি শহরে এই সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে, যা দ্রুত নগরায়ণ ও ক্রমবর্ধমান মনুষ্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও নগর জনসংখ্যার তুলনায় শহরের সংখ্যা ও প্রাকৃতিক প্রসারণের হার অত্যধিক, তবে বড় শহর যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম বা খুলনার বার্ষিক বৃদ্ধির হার গড়ে ২০০ শতাংশের বেশি বলে গবেষণায় জানা যায়।
এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সবুজ ভূমির আচ্ছাদন মোট ভূমির তুলনায় মাত্র ২ দশমিক ৪১ শতাংশ (১০ মিলিয়নের বেশি নগরবাসীর জন্য অবশ্যই অপ্রতুল)। মোটাদাগে অস্বাভাবিক জন ঘনত্ব, কংক্রিটের আচ্ছাদনের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি, অফিস-আদালত/কলকারখানা/পরিবহনের বর্জ্য তাপ এবং অত্যধিক বিল্ডিংয়ের আধিক্য ঢাকার বাতাস ও ভূপৃষ্ঠের ত্বকের উষ্ণতাকে ত্বরান্বিত করছে।
তাছাড়া ঢাকার বিল্ডিংগুলো জলবায়ু সংবেদনশীল নয়, এগুলো দিনেরবেলা সূর্য থেকে প্রাপ্ত আলো ট্রাপ করে, ফলে রাতে যে হারে ঠান্ডা হওয়ার কথা, তা না হয়ে উল্টোটা হয় অর্থাৎ বিল্ডিংগুলো তাপ ধরে রাখে। আর এই উদ্বৃত্ত তাপ আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে স্থানীয় জলবায়ুকে করছে উত্তপ্ত।
ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য নানমূখী পরিকল্পনা ১৯৪৭ সাল থেকে হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫৯ সালের ‘দ্য ঢাকা মাস্টারপ্ল্যান’ অন্যতম, যাতে ছোট একটা ভুলের (জনসংখ্যার ভুল প্রাক্কলন এবং মানুষের অভিগমনকে ধর্তব্যে না নেওয়া) মাশুল-পরবর্তী কয়েক দশক ধরে দিতে হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। হালের নতুন পরিকল্পনা ড্যাপ (ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান) নানা কারণে সমালোচিত। নগর-পরিকল্পনার অন্যতম একটা নির্ণায়ক হচ্ছে ফ্লোর এরিয়া অনুপাত বা এফএআর। প্রস্তাবিত ড্যাপে এই নির্ণায়ককে ঢাকা মহানগরের ক্ষেত্রে সর্বজনীন ধরে জন ঘনত্ব হ্রাসের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা কল্পনাপ্রসূত।
তাছাড়া জলাশয় সম্পর্কিত প্রস্তাবনা বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, স্থানীয় নগর জলবায়ুর কোনো বিষয়ই এতে নেই। ঢাকার তাপমাত্রার ভয়াবহতা ভবিষ্যতে মারাত্মক রূপ নিতে পারে, অথচ এমন একটা বিষয় ড্যাপ আমলেই নিল না! শুধু ড্যাপ কেন, দেশের জলবায়ু সম্পর্কিত নীতিমালা যেমন বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যানেও (২০০৯) নগর জলবায়ুর বিষয়টি উপেক্ষিত। সাম্প্রতিক বদ্বীপ পরিকল্পনায় বিষয়টি এলেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব সুস্পষ্ট।
নগর হিসেবে ঢাকা ৪০০ বছর পার করলেও আন্তর্জাতিক বাসযোগ্যতার সূচকে এর অবস্থান তলানিতে। বিবিএসের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৯ সালে দেশের নগরের জনসংখ্যা হবে ৮১ দশমিক ৪ মিলিয়ন, মানে বাংলাদেশ হবে অন্যতম নগররাষ্ট্র। তাই নগরের উষ্ণতাকে এখনই আমলে না নিলে ঢাকার তথা দেশের নগরগুলোর সমস্যা দিন দিন জটিল হবে, হারাতে পারে বাসযোগ্যতা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩০৩
আপনার মতামত জানানঃ