বিশ্বনেতা, রাজনীতিবিদ ও বিলিয়নিয়রদের গোপন সম্পদ ও আর্থিক লেনদেনের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছে। এ ঘটনাকে প্যান্ডোরা পেপার্স কেলেঙ্কারি হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এ কেলেঙ্কারিতে উঠে এসেছে ৩৫ বর্তমান ও সাবেক বিশ্বনেতাসহ ৩০০-এর বেশি সরকারি কর্মকর্তাদের আর্থিক দুর্নীতি ও সম্পদ গোপনের তথ্য। ফিনসেন ফাইলস, প্যারাডাইস পেপারস, পানামা পেপারস এবং লাক্সলিক্সের পর গত ৭ বছরের মধ্যে এটি সর্বশেষ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা।
প্যান্ডোরা পেপার্স প্রস্তুত করেছে ওয়াশিংটন ডিসির ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) টিম। যেখানে ১১৭টি দেশের ৬৫০ এরও বেশি সাংবাদিক অংশ নিয়েছেন। বিবিসি।
কী আছে প্যান্ডোরা পেপার্সে
আইসিআইজের অনুসন্ধানে পাওয়া নথি গত পাঁচ দশকের। বেশির ভাগই ১৯৯৬ সাল থেকে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ের। ২৯ হাজারের বেশি অফশোর সম্পদের মালিকের তথ্য নথিতে অন্তর্ভুক্ত।
পাঁচ বছর আগে পানামা পেপার্স অনুসন্ধানের চেয়ে দ্বিগুণ অফশোর মালিকের নাম প্যান্ডোরা পেপার্সে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, অফশোর কোম্পানির স্বত্বাধিকারী হওয়া বৈধ হলেও অবৈধ অর্থ লেনদেন, ঘুষ দেয়া, অর্থপাচার, কর ফাঁকি, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, মানব পাচারসহ অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন এসব কোম্পানির মাধ্যমে সম্ভব।
ব্রাজিলিয়ান কোম্পানি ওডেব্রেশটের ঘুষ লেনদেন, ফিফাগেইট নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক ফুটবল কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন দুর্নীতি কেলেঙ্কারি নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে প্যান্ডোরা পেপার্স।
ট্যাক্স হ্যাভেনে সম্পদ লুকানোর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র দেশগুলো। প্যান্ডোরা পেপার্স জানায়, আন্তর্জাতিক নেতারা ট্যাক্স ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখে ধুলা দিয়ে গোপনে অর্থ ও সম্পদ পাচারের সঙ্গে জড়িত।
আইসিআইজে এ অনুসন্ধানকে প্যান্ডোরা পেপার্স বলছে কারণ পানামা ও প্যারাডাইজ পেপার্সের পরম্পরার ভিত্তিতে সাংবাদিকদের মধ্যে আন্তর্জাতিক এ সহযোগিতা গড়ে ওঠে। গ্রিক পুরাণ বর্ণিত প্যান্ডোরার বাক্স এখনও উদ্বেগ ও দুর্দশার প্রতীক।
আইসিআইজের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সময় গড়ানোর সঙ্গে সম্পদ গোপনের অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
প্যান্ডোরা পেপার্স যুক্তরাষ্ট্রের ১৫টি অঙ্গরাজ্যের ২০৬টি ট্রাস্টের নথি জোগাড় করেছে।
ফাঁস হওয়া নথির মাধ্যমে দেখা গেছে, শিকাগোভিত্তিক বহুজাতিক আইনি সংস্থা বেকার ম্যাকেঞ্জি আধুনিক অফশোর ব্যবস্থা সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। আর এই ব্যবস্থা টেকসই রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে পানামার আইনি সংস্থা অ্যালকোগ্যালের।
প্রভাবশালী যেসব বিশ্বনেতা ও ধনকুবেরদের গোপন সম্পদ ও আর্থিক লেনদেনের তথ্য ফাঁস
এ যাবতকালের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক দলিলপত্র ফাঁসের ঘটনায় বিশ্বের বড় বড় নেতা, রাজনীতিবিদ, ধনকুবেরসহ সরকারি কর্মকর্তাদের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চেক প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেই বাবিস, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার— এমন আরও অনেক নেতার গোপন সম্পদের তথ্য এতে প্রকাশ পেয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অফশোর কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগকারী হিসেবে বিভিন্ন দেশের সাবেক ও বর্তমান অন্তত ৩৫ জন নেতার নাম পাওয়া গেছে। এছাড়াও পাওয়া গেছে ৩০০-র বেশি সরকারি কর্মকর্তার নাম।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বনেতা, রাজনীতি ও ধনকুবেরদের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য সংবলিত এই গোপন নথি প্রকাশের মধ্য দিয়ে আবারও একটা বড় ঝাঁকুনি লাগল গোটা বিশ্বে।
প্যান্ডোরা পেপারসকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির নথিগুলোর একটি।
করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত পানামা, দুবাই, মোনাকো, সুইজারল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া দ্বীপপুঞ্জের মতো দেশ এবং অঞ্চলের বিভিন্ন কোম্পানিতে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালীরা যে অর্থ রেখেছেন ও গোপন লেনদেন করেছেন সেই তথ্য ফাঁস হয়েছে প্যান্ডোরা পেপারসে।
গার্ডিয়ান ও বিবিসিসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ওই সব কোম্পানির প্রায় এক কোটি ১৯ লাখ নথি বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে।
ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, জর্ডানের বাদশা গোপনে যুক্তরাজ্য, আমেরিকা ও মালিবুতে ১০ কোটি ডলারের সম্পদ করেছেন।
এছাড়াও যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রী লন্ডনে একটি অফিস কেনার সময় তিন লাখ ১২ হাজার পাউন্ড কর ফাঁকি দিয়েছেন। আর তারা ভবনটি কিনেছিলেন বিদেশে নিজেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে।
ফাঁস হওয়া নথিতে আছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নামও। প্যান্ডোরা পেপারস থেকে জানা গেছে, মোনাকোতে গোপন সম্পদ আছে পুতিনের।
পুতিনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে পরিচিত প্রভাবশালী নারী সভেৎলানা ক্রিভোনোগিখের নামও রয়েছে। পুতিনের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তিনি রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের একান্ত কাছের মানুষ, তার মন্ত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা গোপনে কোটি কোটি ডলার আয় করছে বলে জানানো হয়েছে ফাঁস হওয়া তথ্যে।
এছাড়াও আছেন আগামী সপ্তাহে নির্বাচনের মুখে দাঁড়ানো চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেই ব্যাবিস। তিনি গোপনে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে ১২ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে একটি বিদেশি কোম্পানি মারফত দুটি বাড়ি কিনেছেন।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ ও তার সহযোগীরা যুক্তরাজ্যে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের জমি ও বাড়ি কেনাবেচার চুক্তিতে জড়িত ছিলেন বলে দেখা গেছে ফাঁস হওয়া নথিতে। ইলহাম আলিয়েভের পরিবারের বিরুদ্ধে নিজ দেশের অর্থ লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। প্যান্ডোরা পেপারসের নথিতে দেখা গেছে, এই পরিবার লন্ডনে তাদের একটি সম্পত্তি ব্রিটিশ রাজপরিবারের কাছে বিক্রি করেছে। তাতে আলিয়েভ পরিবারের লাভ হয়েছে চার কোটি ডলারের বেশি।
জানা গেছে, দুর্নীতি দূর করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় বসা ইউক্রেনিয়ার প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তিনিও পূর্বসূরিদের মতোই দুর্নীতিগ্রস্ত। প্যান্ডোরা পেপারসে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তারও অফশোর কোম্পানিতে মালিকানা আছে। এছাড়াও জানা গেছে, সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নিকোস আনাসতাসিয়াদিসের রাশিয়ায় গোপন সম্পদ রয়েছে।
এই আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস জিরা আন্তর্জাতিক জোট আইসিআইজেতে রয়েছেন ৬৫০ জনের বেশি সাংবাদিক।
ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, পানামা, বেলিজ, সাইপ্রাস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশের ১৪টি আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের ফাঁস হওয়া ১ কোটি ১৯ লাখ নথি হাতে পেয়েছে বিবিসি প্যানোরামা, গার্ডিয়ানসহ বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম।
এসব নথি বিশ্লেষণ করে বিবিসি জানায়, এগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, অর্থপাচার, বৈশ্বিক কর ফাঁকির মতো আর্থিক অপরাধ। সবচেয়ে বড় যে বিষয় এই নথির মাধ্যমে সামনে এসেছে, তা হলো এই বিশ্বনেতা ও ধনকুবেররা কীভাবে অন্য দেশে গোপন সম্পদ কেনার জন্য বৈধভাবে বিভিন্ন কোম্পানি খুলে বসেছেন। নানা গোপন সম্পত্তি কেনার সঙ্গে বিদেশে খোলা এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অন্তত ৯৫ হাজার।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন এই আর্থিক কেলেঙ্কারিতে উঠে এসেছে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, মেয়র, সামরিক বাহিনীর জেনারেল, এমনকি বিচারকের নামও। রয়েছেন বিশ্বের শতাধিক বিলিয়নিয়ার, তারকা ও ব্যবসায়ী নেতা।
ভারতের বহু ধনকুবের-ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ প্যান্ডোরার তালিকায়
তালিকায় এসেছে ভারতের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজনের নামও। তাদের মধ্যে রয়েছেন রিলায়েন্স কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান ও ধনকুবের অনিল আম্বানি, পলাতক হীরা ব্যবসায়ী নীরব মোদির বোন, জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা শচীন টেন্ডুলকার। এমনকি রাজনীতিবিদ, আইনবিষয়ক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন এ তালিকায়।
যুক্তরাজ্যের একটি আদালতে ভারতীয় ধনকুবের অনিল আম্বানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। তার সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে প্যান্ডোরা পেপারস। বলা হচ্ছে তার ১৮টি অফশোর কোম্পানির মালিকানা রয়েছে।
ভারত থেকে পালানোর মাত্র এক মাস আগে হীরা ব্যবসায়ী নীরব মোদির বোন একটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
প্যান্ডোরার তালিকায় আছেন ভারতের কোটিপতি উদ্যোক্তা কিরণ মজুমদার সাওয়ের স্বামী জন সাও। তিনি বায়োফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান বিওকন লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত। জানা গেছে, তিনিও একটি ট্রাস্ট গড়ে তুলেছেন সেখানে।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়; প্যান্ডোরা বলছে, তাদের তালিকায় তিন শতাধিক ভারতীয়র নাম রয়েছে। ৬০ প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অফশোর হোল্ডিং রয়েছে। তদন্তের পর তাদের নাম প্রকাশ করবে প্যান্ডোরা।
ভারতীয় ব্যাংকের কয়েক কোটি রুপির ঋণখেলাপির নামও প্যান্ডোরা পেপারসে রয়েছে। এমনকি কারাবন্দীদের অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে একটি বোম্বার্ডিয়ার চ্যালেঞ্জার উড়োজাহাজ কেনার তথ্যও রয়েছে। অনেক প্রোমোটর যাতে ঋণখেলাপি হতে না হয়, সে জন্য তাদের সম্পদ অফশোর ট্রাস্টে বিনিয়োগ করেছেন।
প্যান্ডোরা পেপারসের তালিকায় রয়েছেন ভারতের কয়েকজন রাজনীতিবিদও। তাদের মধ্যে অনেকে পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য। তারা ভারতীয় তদন্ত সংস্থার নজরদারিতে রয়েছেন।
প্যান্ডোরার তালিকায় আছেন রাজস্ব বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা, সাবেক কর কমিশনার, ঊর্ধ্বতন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, আইনবিষয়ক সাবেক কর্মকর্তাও।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছর ঘোরে৷ অর্থনীতির উন্নতি হয়৷ কিন্তু লাভ হয় কেবল বড়লোকদেরই৷ গরিব মানুষের জীবনে কোনো উন্নতি নেই৷ তবে পরিশ্রম করে নয়, পারিবারিকভাবে অথবা সরকারের বদান্যতায়, অথবা গরিব মানুষকে শোষণ করে অর্থবানেরা আরও বেশি অর্থ উপার্জন করছেন৷ ফলে তাদের অর্থ সার্বিক ধনবন্টনে মোটেই সহায়ক হচ্ছে না৷
তারা বলেন, অর্থনীতিতে একটি তত্ত্ব আছে, যেখানে বলা হয়, উপর থেকে চুইয়ে পরা ধনে নীচের অংশ উপকৃত হয়৷ কিন্তু সেই তত্ত্বও এখন কাজ করছে না৷ ধনীর অর্থে গরিবের বিন্দুমাত্র অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না৷ বরং পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে৷
তাদের দাবি, অর্থনীতি এভাবে চলতে থাকলে বিশ্ব জুড়ে অবৈধ কাজ, দুর্নীতি আরো বৃদ্ধি পাবে৷ ইতিমধ্যেই এমন ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে সর্বত্র৷
তারা বলেন, মাত্র গুটি কয়েক মানুষের হাতে এত সম্পদ থাকার বিষয়টি অনুচিত, কারণ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রতি ১০ জনের একজন প্রতিদিন দুই ডলারেরও কম দিয়ে জীবনযাপন করছে৷
আপনার মতামত জানানঃ