আজ ১ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮-এর তিন বছর পূর্ণ হলো। প্রণয়নের পর থেকেই আইনটি বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। সাংবাদিক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকরা ডিজিটাল মাধ্যমে মতামত প্রকাশের জন্য এ আইনের দ্বারা দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। গত তিন বছরে সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে এ আইনের ব্যবহার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে দেশে এবং দেশের বাইরে মানবাধিকার সংগঠনগুলো তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর তিন বছর’ উপলক্ষে এ আইনের ব্যবহারের কিছু পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল ক্ষমতাসীনদলের ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উত্থান। মোট মামলার প্রায় ৮৫ শতাংশই করেছে আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলের শোষণ
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ সাল থেকে প্রাথমিকভাবে তথ্য ও যোগাযোগ আইনের অধীনে এবং পরবর্তীকালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাইবার ট্রাইব্যুনালে করা মোট মামলার সংখ্যা চার হাজার ৬৫৭টি। এর মধ্যে ৯২৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০১৮ সালে, এক হাজার ১৮৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০১৯ সালে এবং ২০২০ সালে দায়ের করা মামলার সংখ্যা এক হাজার ১২৮টি। এছাড়া ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১- এই সময়ের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮-এর অধীনে দেড় হাজারেরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে এই আইনের ব্যবহার করেছেন এবং এই ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। এসব মামলা চিহ্নিত করে নথিভুক্ত করেছে সিজিএস। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গত ২১ মাসে হওয়া ৬৬৮টি মামলা পর্যবেক্ষণ করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) জানিয়েছে, এই মামলাগুলোর বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা না হয়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা তাদের নেতাদের পক্ষ হয়ে করেছেন।
যেসব রাজনৈতিক মামলা তারা খুঁজে পেয়েছে, তার ৮৫ ভাগ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা, যদিও মোট কতগুলো মামলাকে তারা রাজনৈতিক মামলা হিসেবে বিবেচনা করেছেন, সে তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর তিন বছর: একটি পর্যবেক্ষণমূলক ফলাফল’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক মামলা ছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ৭৬টি মামলা করেছে, যা মোট দায়েরকৃত মামলার ২০ দশমিক ৩২ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে এই পর্যবেক্ষণের মূখ্য গবেষকের মন্তব্য, ‘আইনটি ভিন্নমতকে অপরাধে পরিণত করছে।’ এ সংক্রান্ত প্রকল্পটি ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রকল্পে মুখ্য গবেষক হিসেবে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিজিএস ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৬৮ টি মামলার বিবরণ চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। এই মামলাগুলোয় অভিযুক্তের সংখ্যা ১ হাজার ৫১৬ জন, যার মধ্যে ১৪২ জন সাংবাদিক, ৩৫ জন শিক্ষক, ১৯৪ জন রাজনীতিবিদ, ৬৭ জন শিক্ষার্থী।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাংবাদিক ২৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। মামলাগুলোতে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সাংবাদিকদের সংখ্যা অসমভাবে বেশি। গ্রেপ্তারকৃত ৪৯৯ জনের মধ্যে ৪২ জন সাংবাদিক, ৫৫ জন রাজনীতিবিদ, ৩২ জন শিক্ষার্থী। এমনকি ১৮ বছরের কম বয়সী ১৩ জনকেও এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।
সিজিএসের পর্যবেক্ষণ বলছে, এই আইনের অধীনে এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানহানির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে ৭৪টি। এর মধ্যে ১৩টি মামলা করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও ৬১টি মামলা করেছে অন্যরা। এছাড়া মন্ত্রীদের মানহানির অভিযোগে ৪১টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৪টি মামলা করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে, ৩৪টি মামলা করেছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা।
বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এই মামলাগুলো অত্যন্ত ধীরগতির উল্লেখ করে সিজিএস বলেছে, এখন পর্যন্ত মাত্র ২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। তাছাড়া আইন অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে সাইবার ট্রাইব্যুনালের অনুমোদন সাপেক্ষে আরও ৩০ দিন সময় দেওয়া হয়। কিন্তু গত তিন বছর ধরে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করার পরেও অভিযুক্ত এখনও হেফাজতে আছে এবং বিচারের আগেই তারা কার্যকরভাবে শাস্তি ভোগ করছেন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ এসব প্রবণতাকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং গুরুতর রকমের আশঙ্কাজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ‘এই প্রবণতা দেখাচ্ছে যে কীভাবে একটি আইন উদ্ভূত কর্তৃত্ববাদের দিকে অগ্রসরমান শাসনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।’
তিনি বলেন, ‘আইনটির নির্বিচার ব্যবহার বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইনটি বাতিল করা জরুরি।’
ভিন্নমত যেখানে অপরাধ
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত তিন বছরে সাংবাদিক, রাজনীতিক, শিল্পী, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, গার্মেন্টসকর্মী থেকে শিক্ষক ছাত্র পর্যন্ত আসামী হয়ে জেল খেটেছেন।
এ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং উদ্বেগের মূল কারণ হিসেবে বলা হয় বেশকিছু ধারার মাধ্যমে যথেচ্ছা হয়রানির সুযোগ রয়েছে। এ আইনের ৪৩ ধারায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ এবং আটকের অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
আর আইনে ব্যাক্তি বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তী ক্ষুণ্ন করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা উস্কানি, মানহানিকর তথ্য প্রচার ও প্রকাশ এবং আইন শৃঙ্খলার অবনতির মতো বিষয়গুলোতে বিভিন্ন ধারায় অপরাধ ও শাস্তির বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, সংবিধানে নাগরিকদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সবার মধ্যে একটা ভীতি যে এইটা বললে কী হবে! এবং আমরাও বলি যে এতকিছু বলো না তোমার বিপদ হবে। এটা স্বাধীন দেশে আমরা কেন করবো? এটা কিন্তু বেশ স্বার্থকভাবে সরকার করে ফেলেছে। সেল্ফ সেন্সরশিপ একটা ভীতি প্রদর্শন, ভীতি মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া।”
এদিকে, বাংলাদেশে অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রেকর্ড হারে কমেছে। এর পেছনে দুটি কারণ উল্লেখ করেছে মার্কিন অলাভজনক গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউস। প্রথমত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ধরপাকড় জারি রেখেছে সরকারি কর্তৃপক্ষ। দ্বিতীয়ত, ক্রমেই অভিনব সব উপায়ে সরকারি নজরদারির খবর আসছে সামনে।
ফ্রিডম হাউসের ‘ফ্রিডম অন দ্য নেট ২০২১’ প্রতিবেদনে ইন্টারনেটে বাক্স্বাধীনতার সূচকে ১০০-তে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে ৪০ পয়েন্ট। গত বছর এই পয়েন্ট ছিল ৪২। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০১৯ সালে ৪৪, ২০১৮ সালে ৪৯, ২০১৭ সালে ৪৬ ও ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পেয়েছিল ৪৪ পয়েন্ট।
প্রাপ্ত পয়েন্টের ভিত্তিতে দেশগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। পয়েন্ট ১০০ থেকে ৭০-এর মধ্যে থাকলে ‘মুক্ত’, ৬৯ থেকে ৪০-এর মধ্যে থাকলে ‘আংশিক মুক্ত’ এবং ৩৯-এর নিচে হলে ‘মুক্ত নয়’। আংশিক মুক্ত শ্রেণির তলানিতে বাংলাদেশ। অবশ্য ২০১৩ সাল থেকে বরাবরই আংশিক মুক্ত দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞের ভাষ্যমতে
অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, ২০০৬ সালে যখন যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন করা হয়েছিল তখনই কিন্তু সবাই এটার প্রতিবাদ করেছিলেন। ২০১৩ সালে এটা সংশোধন করে শাস্তির মাত্রা আরো কঠোর করা হয়েছিল। তখন ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছিল, সবাই এটার প্রতিবাদ করেছেন। ২০১৮ সালে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া হয় তখন কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম ওই ৫৭ ধারাই নানাভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হলো। তখন কিন্তু সম্পাদক পরিষদ, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বা টিভি মালিকদের সংগঠন এটার প্রতিবাদ করেছিলেন। সংসদীয় কমিটির সামনেও যুক্তিগুলো উপস্থাপন করা হয়েছিলো। তারপরও এটা পাশ হয়ে গেল। সমস্যা হচ্ছে এটার খুব বেশি অপপ্রয়োগ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই ধরনের আইনগুলো করাই হয়, ক্ষমতাবানদের স্বার্থরক্ষার জন্য।
প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘৬৬৮টি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা এক হাজার ৫১৬ জন। এর মধ্যে ১৪২ জন সাংবাদিক, ৩৫ জন শিক্ষক, ১৯৪ জন রাজনীতিবিদ ও ৬৭ জন শিক্ষার্থী। আমরা ৫৭১ জন মানুষের পেশা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি। মোট মামলার প্রায় নয় দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং যাদের পেশা চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ ব্যক্তি সাংবাদিক। ’
তিনি বলেন, ‘এসব মামলার বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা না হয়ে অন্যদের মাধ্যমে দায়ের করা হয়েছে। প্রায়ই ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা তাদের নেতাদের পক্ষ নিয়ে মামলাগুলো দায়ের করেন। অভিযোগকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় চিহ্নিত করার পর দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মামলা করেছে ৭৬টি, যা মোট মামলার ২০ দশমিক ৩২ শতাংশ। ’
ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘মন্ত্রীদের মানহানির অভিযোগে ৪১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে। বাকি ৩৭টি মামলা দায়ের করেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৭ জনকে। জামিন পেয়েছেন তিন জন। ’
প্রকল্পটির মুখ্য গবেষক ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘এই প্রবণতা দেখাচ্ছে যে কীভাবে একটি আইন উদ্ভূত কর্তৃত্ববাদের দিকে অগ্রসরমান শাসনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এটি ভিন্নমতকে অপরাধে পরিণত করছে। এই আইনের নির্বিচার ব্যবহার বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইনটি বাতিল করা জরুরি।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/০৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ