দুর্বৃত্তদের বাদ দিলে কোন বাঙালিকে প্রথম ফাঁসি দিয়েছিল ব্রিটিশরা? প্রথমেই মাথায় আসবে ক্ষুদিরাম বসু-র নাম। কিন্তু তা নয়। ১৯০৮-এর ১১ আগস্টে ১৮ বছর বয়সী এই কিশোরের আগেও এক সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ প্রাণ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ ফাঁসিকাঠে। ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট। তার নাম মহারাজা নন্দকুমার।
কথায় বলে, প্রত্যেকেই তার কৃতকর্মের শাস্তি পান। তেমনই এক হতভাগ্য পুরুষ মহারাজা নন্দকুমার। নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজশক্তির কাছে। কিন্তু সেই ব্রিটিশ আদালতের বিচারেই তার ফাঁসি হয়। দিনটা ছিল ৫ আগস্ট, ১৭৭৫। অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক ২৪৫ বছর আগে। আর সেটাই ছিল একটা পরিপূর্ণ বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ শাসনে প্রথম ফাঁসি।
নন্দকুমারের জন্ম ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে। ভদ্রপুরে; এখন এটি পড়ে বীরভূম জেলায়। মহারাজা নন্দকুমার, মুঘল অভিজাত শ্রেণীর খেতাব প্রাপ্ত অভিজাত এবং পলাশির যুদ্ধের সময় হুগলির ফৌজদার। পরবর্তীকালে তিনি নবাব মীরজাফরের দেওয়ান ছিলেন এবং কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভের অব্যবহিত পরে তিনি ছিলেন চার জন ঊর্ধ্বতন নায়েবের অন্যতম। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম তাকে ‘মহারাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাকে কর আদায়ের কাজে বহাল করে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে; বর্ধমান‚ নদিয়া এবং হুগলি জেলায়। তার আগে এই দায়িত্বে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। কিন্তু তার কাজে সন্তুষ্ট ছিল না কোম্পানি। এই অপসারণ মেনে নিতে পারেননি তিনি। তাকে সরিয়ে কিনা দায়িত্ব দেওয়া হল এক নেটিভকে! অপমানে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকেন হেস্টিংস।
১৭৭৩ সালে হেস্টিংসকে বাংলার গভর্নর জেনারেল পদে আনা হল। সে বার তার বিরুদ্ধে লিখিত ভাবে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন নন্দকুমার। তার অভিযোগ ছিল‚ মৃত নবাব মীরজাফরের বেগম মুন্নি বেগমের কাছ থেকে বহু কোটি অর্থ ঘুষ নিয়েছিলেন হেস্টিংস। বিনিময়ে নাবালক নবাব মুবারক-উদ-দৌল্লার অভিভাবক হিসেবে মুন্নি বেগমকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন৷ রেগুলেটিং অ্যাক্ট-এর বিধানে গভর্নর জেনারেলকে কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হত।
দুর্ভাগ্যবশত কাউন্সিলের চারজন সদস্যের তিনজনই হেস্টিংসের বিরুদ্ধে ছিলেন। কাউন্সিলের বিরোধী তিনজন সদস্য ছিলেন ক্ল্যাভারিং, ফ্রান্সিস ও মনসন। মূলত নন্দকুমারের কারণে হেস্টিংসকে অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। এদিকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দ্বারা গৃহীত কার্যবিবরণীতে উৎকোচ গ্রহণের বিষয়টি চিহ্নিত করে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স-এর কাছে প্রেরণ করা হয়।
নন্দকুমারের বিচার-বিষয়ক তথ্যানুসন্ধান করে বেভারিজ বলেছেন যে, নন্দকুমারের প্রতি তার অস্বাভাবিক বিদ্বেষের ফলে হেস্টিংস নন্দকুমারকে তার প্রাপ্য’ শাস্তি দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন। নন্দকুমারের ফাঁসির কাহিনী নিয়ে লিখেছেন এমন লেখকদের অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছেন যে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারক স্যার এলিজা ইম্পের সহযোগিতায় হেস্টিংস এই ‘আইনি হত্যা’র আয়োজন করেন। ওয়েস্ট মিনিস্টার স্কুলে ইম্পে ছিলেন হেস্টিংসের বন্ধু। শত্রুকে নির্মূল করে ইম্পে বন্ধুকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন।
ব্যাবিংটন মেকলের মতে, ইম্পে ছিলেন চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ ও অসৎ চরিত্রের কুখ্যাত ব্যক্তি। ইম্পে সম্পর্কে মেকলের মন্তব্যের সঙ্গে লর্ড কর্নওয়ালিসের মতের সাদৃশ্য রয়েছে। কর্নওয়ালিস বোর্ড অব কন্ট্রোল-এর সভাপতির কাছে লিখিত বেশ কিছু চিঠিতে ইম্পের অর্থলালসা, পক্ষপাত দোষ এবং নীচতা ও অসাধুতার উল্লেখ করেন। অভিযোগটি সাধারণভাবে প্রচলিত থাকলেও হেস্টিংস কর্তৃক তার বন্ধু ইম্পেকে সরাসরি প্ররোচনা দেওয়ার বিষয়টি এখনও যথাযথভাবে প্রমাণিত হয়নি।
মুখ বন্ধ রাখার জন্য এর থেকে বিশাল অর্থ নন্দকুমারকেও দিতে চেয়েছিলেন হেস্টিংস। কিন্তু তা না নিয়ে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেন নন্দকুমার। মহারাজা নন্দকুমারকে সমর্থন করেন স্যর ফিলিপ ফ্রান্সিস এবং বেঙ্গল সুপ্রিম কাউন্সিলের অন্য সদস্যরা। হেস্টিংসের বিরোধী ছিলেন ফ্রান্সিস। কিন্তু কোনও লাভ হল না। কারণ ভারতের প্রথম চিফ জাস্টিস এলিজা ইম্পে ছিলেন হেস্টিংসের স্কুলের বন্ধু। তিনি রায় দিলেন নন্দকুমারের বিপক্ষে।
নন্দকুমারের মামলাটি ছিল অতি সাধারণ। সামান্য একটি জালিয়াতির মামলায় তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ব্রিটিশ আদালতে অবশ্য জালিয়াতির শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এদেশের চিরাচরিত আইনে এমন কঠোর শাস্তির কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না।
নন্দকুমারের সঙ্গে জহরতের কারবার চলত বোলাকিদাস জহুরির। নবাব মীর কাশিমের আমলে একবার নন্দকুমার তাকে একটা মুক্তার হার, একটা কলকা, একটা শিরপেচ এবং চারটি হীরার আঙটি বিক্রি করতে দেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় কাশেমবাজার লুঠ হওয়ায় বোলাকিদাসের নিজের জিনিসের সঙ্গে এগুলিও লুঠ হয়ে যায়। অতঃপর বোলাকিদাস নন্দকুমারকে ৪ হাজার ২১ টাকা পরিশোধ করবেন বলে অঙ্গীকারপত্র লিখে দেন। সেইসঙ্গে ৪ শতাংশ হারে সুদ দেবেন বলেও জানান। বোলাকিদাসের মৃত্যুর পর পদ্মমোহন দাস সেই টাকা পরিশোধও করেন। কিন্তু পদ্মমোহনের মৃত্যুর পর বোলাকির এক আত্মীয় গঙ্গাবিষ্ণু সেই টাকার হিসাব নিয়ে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
নন্দকুমার তখন তার কাছে থাকা অঙ্গীকারপত্রের জোরে মুক্তি পান। কিন্তু ঠিক এই সময় ১৭৭৩ সালে হেস্টিংস আবার কলকাতায় এলেন। এবার তিনিই গভর্নর জেনারেল। সেইসঙ্গে রেগুলেটিং অ্যাক্ট অনুসারে কলকাতায় তৈরি হল হাইকোর্ট। তখন হেস্টিংসের পরামর্শে গঙ্গাবিষ্ণু হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন এবং বোলাকিদাসের অঙ্গীকারপত্রটি জাল বলে দাবি করেন। এই মর্মে মামলা শুরু হয় ১৭৭৫ সালের ১২ মে।
এই মামলাতেই লঘু পাপে গুরু দণ্ড পান নন্দকুমার। ফাঁসির দিন নির্ধারিত হল ১৭৭৫ সালের ৫ অগাস্ট। মৃত্যুর স্থান নিজেই বেছে নিয়েছিলেন মহারাজা নন্দকুমার। গঙ্গাকে সামনে রেখে মৃত্যুবরণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। পূর্ণ হয়েছিল তার শেষ ইচ্ছে। নির্দিষ্ট দিনে খুব শান্ত ভাবে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিলেন সত্তরোর্ধ্ব মহারাজা নন্দকুমার। ঠিক কোনখানে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল‚ জানা যায় না।
খিদিরপুরের কাছে কুলিবাজার অঞ্চল; তখন সেই জায়গা ছিল লোকালয় বর্জিত। সেই নিরুপদ্রুত রাজপথেই সেদিন ছিল লোকে লোকারণ্য। এর আগে ফাঁসি অনেকেই দেখেছেন। ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে ফাঁসি দেওয়া হত রাস্তার ধারে গাছের উপর থেকে। প্রত্যেকে যাতে অপরাধীর অন্তিম পরিণতি প্রত্যক্ষ করেন, তাই এই ব্যবস্থা ছিল। নন্দকুমারের ফাঁসিও হয়েছিল প্রকাশ্যে।
কিন্তু তার জন্য একটা আস্ত কূপ খোঁড়া হয়েছিল। এ তো হাইকোর্টের রায়ে ফাঁসি। সাধারণ জমিদারি মামলা তো নয়। তাই এমন ঘটনার সাক্ষী থাকতে ভিড় ভেঙে পড়েছিল। এমনকি ব্রাহ্মণ হত্যার সাক্ষী থাকার অপরাধ মেনে নিয়েছিল ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা।
শোনা যায় নিজের সপক্ষে যাবতীয় যুক্তি নন্দকুমার পেশ করেছিলেন। কিন্তু বিচারপতি এলিজা ইম্পে তার কোনো কথাতেই কর্ণপাত করেননি। হেস্টিংসের প্রাণের বন্ধু এলিজা শুধু ভেবেছিলেন, কী কী প্রকারে নন্দকুমারকে শাস্তি দেওয়া যায়।
অবশেষে ১৬ জুন ফাঁসির রায় বেরোল এবং ৫ আগস্ট ফাঁসির দিন স্থির করা হল। তবে এর পরেও নাকি মামলা গড়িয়েছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। সেখানে হেস্টিংস এবং এলিজা দুজনকেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কারণ প্রথমত যে মামলায় নন্দকুমার শাস্তি পেলেন সেটি শুরু হয়েছিল হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার আগে। অতএব আইন মোতাবেক তা হাইকোর্টের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। দ্বিতীয়ত, ইংল্যান্ডের আইনে জালিয়াতির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও ভারতের হিন্দু আইন বা মুসলমান আইনে তা নয়।
বরং তৎকালীন আইন অনুযায়ী কোনো ব্রাহ্মণকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেত না। কিন্তু এইসব প্রশ্ন যখন ওঠে তখন পুনরায় বিচার করার আর কোনো সুযোগই নেই। মহারাজা নন্দকুমার অনেকদিন আগেই ফাঁসির দড়ি গলায় পরে নিয়েছেন। সুবিচার হয়েছিল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। রহস্য আছে সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাকারীদের অকাল মৃত্যু ও নির্মম পরিণতি নিয়েও। মহারাজ নন্দকুমার মূলত এই রহস্যকেই বাড়িয়ে দিয়েছেন বেশ খানিকটা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ