প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ধর্ষণের শিকার হলেও, দেশের আইন সেটাকে ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। আইনে পুরুষের যৌন হয়রানি নিয়ে সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। ধর্ষণের সংজ্ঞায় যে গুরুতর ফাঁক রয়েছে, তার দিকে আইনপ্রণেতাদের নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন আইনজীবী ও গবেষকেরা।
আমাদের ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে যৌন সহিংসতার সাথে সম্পৃক্ত যতগুলো ধারা আছে, সেগুলোতে পরিষ্কার বলা রয়েছে ‘যখন একজন পুরুষ একজন নারীর’ বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতামূলক আচরণ করেন। অর্থাৎ ধরেই নেয়া হয়েছে যে একজন পুরুষ নিজে যৌন আক্রমণের শিকার হতে পারেন না।
এরকম ক্ষেত্রে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন হলে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় মামলা হতে পারে। অথবা ভুক্তভোগী শারীরিকভাবে আঘাত পাওয়ার অভিযোগ করতে পারেন। যার ফলে বাংলাদেশে ১৬ বছরের বেশি বয়সী একজন পুরুষ তার বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা হলেও তার অভিযোগ নিয়ে আইনগতভাবে সুবিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ধর্ষণের শিকার ৫ শতাংশ পুরুষ
২০১৩ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের বহু রাষ্ট্রীয় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৫ শতাংশ পুরুষ ধর্ষণের শিকার হন। ১৮ বছরের নিচে ধর্ষণসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয় ৩৭ শতাংশ।
ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ছয়টি দেশের ১০ হাজার পুরুষ ও ৩ হাজার নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ২ হাজার ৪০০ পুরুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের পক্ষে গবেষণাটি পরিচালনা করেছিলেন আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রুচিরা তাবাসসুম নভেদ।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, যেসব দেশে যৌনতা নিয়ে কড়াকড়ি বেশি, ছেলেমেয়েদের আলাদা করে রাখা হয়, সেসব দেশে অনেক সময় যৌনতার প্রকাশ এভাবে ঘটে।
এর বাইরে কিছু পুরুষ পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট থাকেন। সামাজিকভাবে এসব পুরুষের কিছু করার উপায় থাকে না বলে পুরুষ ধর্ষণের দিকে ঝোঁকেন। আবার নারী ধর্ষণের মতো পুরুষ ধর্ষণকেও একধরনের ‘বাহাদুরি’ বলে মনে করেন কিছু পুরুষ।
সাড়ে চার বছরে ১৭৪ ছেলেশিশুকে ধর্ষণ
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংস্থার জ্যেষ্ঠ তথ্য সংরক্ষক নার্গিস আক্তারের একটি লেখায় বলা হয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত সাড়ে চার বছরে ১৭৫টি ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ১৩ শিশু।
এছাড়া ২০১৭ সালে ২৬, ২০১৮ সালে ৯, ২০১৯ সালে ৪১, ২০২০ সালে ৫৫ এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৮ জুন পর্যন্ত ৪৩ জন ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর এক শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আরেক শিশুকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার ৪৩ শিশুর মধ্যে ২৫ জন মাদ্রাসার।
নার্গিস আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, এই শিশুদের ০-১৮ বছরের গ্রুপে তালিকাভুক্ত করেছেন তারা। সে ক্ষেত্রে ১৬ বছরের বেশি বয়সী কতজন ছিল, সেটা আলাদা করে হিসাব করা নেই।
আইনের ফাঁকফোকর
বিশেষজ্ঞরা বলেন, “বাংলাদেশে ধরেই নেয় হয় যে ‘পেনিট্রেশন’ মানে নারীর যৌনাঙ্গে পুরুষের যৌনাঙ্গ প্রবেশ করানো। ফলে পুরুষ বা অন্য লিঙ্গের মানুষের বিচার পেতে এটি মূল বাধা হয়ে রয়েছে।”
দণ্ডবিধি ৩৭৫ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর ৯ ধারা অনুসারে ধর্ষণের সংজ্ঞা হচ্ছে, নারী ও শিশুর প্রতি পুরুষের অপরাধ সংঘটন। কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ধর্ষণের শিকার হলেও আইনের চোখে তা ধর্ষণ নয়। আবার দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারাটি মূলত সমকামিতার অপরাধ হিসেবেই চিহ্নিত হয়।
অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় শিশুর বয়স ১৬ পর্যন্ত বিবেচনা করে। অথচ দেশের শিশু আইনে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সকে শিশু বলে ধরা হয়। ফলে ১৬ বছরের বেশি বয়সী এবং ১৮ বছরের নিচের বয়সী ছেলেরা ধর্ষণের শিকার হলেও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে বিচার পায় না।
আইনের বিভিন্ন ধারার ব্যাখ্যা দিয়ে ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি বিভাগের অ্যাডভোকেসি লিড তাকবির হুদা বলেন, নারী ধর্ষণকে ধর্ষণের ‘স্বাভাবিক’ রূপ বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। তবে পুরুষ ধর্ষণ বাংলাদেশে এখন যে আর ‘অচিন্তনীয়’ কোনো ব্যাপার না, তা মেনে নেওয়ার সময় হয়েছে। মাদ্রাসাতেও ছেলে শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অনেক ঘটনা ঘটছে।
দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় সংশোধন চেয়ে ১৪ জানুয়ারি উচ্চ আদালতে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাসমিয়া নূহাইয়া আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ ও সমাজকর্মী সৌমেন ভৌমিক।
শুনানির অপেক্ষায় থাকা রিটটি পরিচালনা করেন আইনজীবী তাপস কান্তি বল। তিনি বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ধর্ষণের ঘটনা অনেক বেশি ঘটলেও, এটাকে ধর্ষণ বলে শনাক্ত করা হচ্ছে না। ৩৭৭ ধারায় ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ’ উল্লেখ করে দুই পুরুষের মিলিত হওয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার হয়েও উল্টো শাস্তি পাওয়ার ভয়ে অনেক পুরুষ পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন না।
তাপস কান্তি বল আরও বলেন, রিট করার সময় ধর্ষণের শিকার ১৬ বছরের কম এবং বেশি বয়সী দুটি ছেলের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুটি ধর্ষণের মামলা করতে পেরেছিল। তবে ১৬ বছরের বেশি বয়সী ছেলেশিশুটি পারেনি।
সে থানায় ধর্ষণের মামলা করতে গেলে ৩৭৭ ধারায় মামলা নিতে চেয়েছিল পুলিশ। সে ক্ষেত্রে আরও ভুক্তভোগী হওয়ার আশঙ্কায় ছেলেটি মামলা না করে ফিরে আসে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, আমরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখছি যে, ঘটনাগুলো বিভিন্নভাবে ঘটে। যেমন একজন পুরুষ কর্তৃক একজন পুরুষ ধর্ষণের শিকার হন বা একজন পুরুষ কর্তৃক শিশুদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। একজন নারী দ্বারা অন্যের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও ধর্ষণের শিকার হন। এই বিষয়গুলো আইনে নেই। ফলে এসব ঘটনা আমরা আইনের আওতায় আনতে পারি না। এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১২২৫
আপনার মতামত জানানঃ