আফগানিস্তান তালিবানের দখলে যাবার পর এবার নতুন করে সরকার গঠন করা হলো। ৩৩ জন মন্ত্রিসভার সদস্যের সমন্বয়ে গতকাল মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) আফগানিস্তানের নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন মন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেছে তালিবান।
এর মধ্যে জাতিসংঘের সন্ত্রাসী তালিকায় থাকা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ হয়েছেন আফগানের নতুন ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী। এফবিআই’র ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ সিরাজউদ্দিন হাক্কানি হয়েছেন ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। জোট বাহিনীর উপর হামলাকারী আবদুল গনি বারাদার ভারপ্রাপ্ত উপ-প্রধানমন্ত্রী।
আফগানিস্তানের তালিবান গোষ্ঠীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর পরিচালনা পরিষদ ‘রাহবার-ই-শুরা’র প্রধান মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। উপ-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তালিবানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মোল্লা আবদুল গনি বারাদার।
এর আগেই তালিবান সরকারের প্রধান হিসেবে বারাদারের নাম জানায় তালিবান। আর ইরানের ইসলামী সরকারের আদলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদার নাম জানান তালিবানের একাধিক কর্মকর্তা।
সে হিসেবে মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান ঘোষণা কিছুটা অপ্রত্যাশিতই ছিল। তাছাড়া, অন্যান্য নেতাদের মতো তার পরিচিতি গণমাধ্যমে খুব একটা আলোচনাও হয়নি।
জাতিসংঘের সন্ত্রাসী তালিকায় থাকা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ, ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী
তালিবান গোষ্ঠীর প্রভাবশালী ‘রাহবার-ই-শুরা’ আসলে শীর্ষ নেতাদের পরিষদ। এ পরিষদের প্রধান হিসেবে হাসান আখুন্দ প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। তালিবানের অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়ের পরিচালনা এখান থেকেই করা হয়। কাঠামোও অনেকটা একটি সরকারের মন্ত্রীসভার মতোই। তবে যেকোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার শীর্ষ নেতা তথা মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দের হাতে। তার অনুমোদন সাপেক্ষেই বাস্তবায়িত হয় সকল পদক্ষেপ।
সূত্র মতে, তালিবানের শীর্ষ নেতা মোল্লা হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদা নিজেই সরকার প্রধান হিসেবে মোল্লা হাসানের নাম প্রস্তাব করেন। তালিবান যে শহরে গঠিত হয়, সেই কান্দাহারেরই বাসিন্দা মোল্লা হাসান। তিনিও গোষ্ঠীটির অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।
গত দুই দশক ধরে তিনি রাহবার-ই-শুরার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদার সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত তালিবানের প্রথম সরকারে মোল্লা হাসান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
ভারতের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি বার্তাসংস্থা ইন্দো-এশিয়ান নিউজ সার্ভিসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মোল্লা হাসান একজন কট্টরপন্থী ব্যক্তিত্ব, ২০০১ সালের মার্চে তার তত্ত্বাবধানেই আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশের বিখ্যাত বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা হয়। জাতিসংঘ এখনও তাকে সন্ত্রাসী তালিকায় রেখেছে।
তবে মোল্লা হাসানের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ব্যক্ত করে আখুন্দজাদা বলেছেন, ‘তিনি রাহবার-ই-শুরার প্রধান হিসেবে ২০ বছর ধরে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এমন একজন শীর্ষ ধর্মীয় নেতা, যিনি সচ্চরিত্র ও নিষ্ঠার জন্য সুপরিচিত’।
তালিবানের জন্মস্থান কান্দাহারের বাসিন্দা তিনি। তবে, আখুন্দের সঠিক বয়স নিয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি। কিছু পর্যবেক্ষক তাকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি বা সম্ভবত তার চেয়েও বেশি বয়স্ক বলে মনে করেন। একজন ধর্মীয় ব্যক্তির চেয়ে রাজনৈতিক হিসেবে তার পরিচিত বেশি এবং নেতৃত্ব পরিষদের উপর তার নিয়ন্ত্রণের কারণে সামরিক বিষয়েও মতামত রাখতে পারেন তিনি।
এফবিআই’র ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ সিরাজউদ্দিন হাক্কানি, ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
২০১৮ সালে তার পিতা জালালুদ্দিন হাক্কানির মৃত্যুর পর প্রভাবশালী হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজউদ্দিন হাক্কানি নেতা হিসেবে উপনীত হন।
আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সবচেয়ে কার্যকর সোভিয়েত-বিরোধী মিলিশিয়া হিসেবে বিবেচিত আধা-স্বায়ত্তশাসিত এ গোষ্ঠীকে জোট বাহিনীর ওপর মারাত্মক কিছু হামলার জন্য দায়ী করা হয়।
তবে তালিবান কাঠামোর মধ্যে হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঠিক অবস্থান নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এ নেটওয়ার্কটিকে একটি বিদেশী সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নাম দেয়।
জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা কমিটি আরও জানায়, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে আইনবিহীন সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত এই দলটি মাদক উৎপাদন ও বাণিজ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
জাতিসংঘের সন্ত্রাসী তালিকায় থাকা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ হয়েছেন আফগানের নতুন ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী। এফবিআই’র ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ সিরাজউদ্দিন হাক্কানি হয়েছেন ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। জোট বাহিনীর উপর হামলাকারী আবদুল গনি বারাদার ভারপ্রাপ্ত উপ-প্রধানমন্ত্রী।
আত্মঘাতী হামলায় জড়িত থাকা এবং আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে এফবিআইয়ের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ব্যক্তিদের মধ্যে হাক্কানি একজন। এছাড়া, তাকে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পুরস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
জোট বাহিনীর উপর হামলাকারী আবদুল গনি বারাদার, ভারপ্রাপ্ত উপ-প্রধানমন্ত্রী
বারাদার এককালে মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ‘বারাদার’ কিংবা ‘ব্রাদার’ ডাকনামটি ওমরই তাকে দিয়েছিলেন। আফগানিস্তানে তালিবানের শেষ শাসনামলে তিনি উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
জাতিসংঘের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তালিবান সরকার পতনের পর জোট বাহিনীর ওপর হামলার জন্য দায়ী একজন সিনিয়র সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বারাদার।
এর আগে তিনি ২০১০ সালে পাকিস্তানে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে বন্দি হন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি দোহায় তালিবানদের রাজনৈতিক কার্যালয়ের নেতৃত্ব দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনার অন্যতম প্রধান একজন ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।
আমির খান মুত্তাকি, ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মূলত পাকটিয়ার বাসিন্দা মুত্তাকি নিজেকে হেলমন্দ এর বাসিন্দা বলে পরিচয় দেন। মুত্তাকি বিগত তালিবান সরকারের সময় সংস্কৃতি ও তথ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শান্তি কমিশন ও আলোচনা দলের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করে কাতারে পাঠানো হয় তাকে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় বসতেন তিনি।
তিনি কোনো জঙ্গি কমান্ডার বা ধর্মীয় নেতা ছিলেন না। তালিবান সূত্রে জানা যায়, মুত্তাকি মূলত দাওয়াত ও নির্দেশনা কমিশনের চেয়ারম্যান।
আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য চলা লড়াইয়ের সময় তিনি বিবৃতি এবং বক্তৃতার মাধ্যমে একজন মধ্যমপন্থী হিসেবে কাজ করেন।
শহরাঞ্চলে যুদ্ধ এড়াতে তালিবানের সাথে কথা বলার জন্য প্রাদেশিক রাজধানীতে লুকিয়ে থাকা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। কাবুল পতনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, মুত্তাকি পানশির প্রদেশকেও শান্তিপূর্ণভাবে যুদ্ধ নিষ্পত্তির আহ্বান জানান।
মোল্লা ইয়াকুব, ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী
তালিবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের পুত্র ইয়াকুব মূলত ২০১৫ সালে তার বাবার উত্তরাধিকারী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তার বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে মোল্লা আখতার মনসুরকে নিযুক্ত করা কাউন্সিল বৈঠক থেকে ক্ষিপ্রতার সাথে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত এর সমাধান হয়েছিল।
এখনও বয়স ত্রিশের গোঁড়ায় থাকা ইয়াকুবের নেই তালিবানের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রের কমান্ডারদের মত অভিজ্ঞতা। কিন্তু তার বাবার নামের প্রতিপত্তির কারণে কান্দাহারের আন্দোলনে একটি অংশের আনুগত্যের আদেশ দেন তিনি।
গত বছর তালিবান সামরিক কমিশনের সার্বিক প্রধান হিসেবে মনোনীত করা হয় তাকে। তখন থেকে আফগানিস্তানে সকল সামরিক অভিযানের তত্ত্বাবধান করেছেন এবং তালিবানের তিনজন উপ‑নেতার একজন ছিলেন। তার সাথে বাকি দুজন ছিলেন বারাদার ও সিরাজউদ্দিন হাক্কানি।
যদিও কিছু পশ্চিমা বিশ্লেষক তাকে আপেক্ষিক মধ্যপন্থী হিসেবে বিবেচনা করেন, তালিবান কমান্ডাররা বলেছেন যে তিনি কাবুল পতনের আগের সপ্তাহগুলোতে সামরিক অভিযান জোরদার করার জন্য দায়িত্বরত নেতাদের মধ্যে একজন।
জাবিউল্লাহ মুজাহিদ, ভারপ্রাপ্ত উপ-তথ্যমন্ত্রী
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গোষ্ঠীটির নানা কার্যক্রমের তথ্য প্রকাশ করে আসছেন তালিবানের দীর্ঘদিনের মুখপাত্র মুজাহিদ। তার টুইটার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নিয়মিত তিনি আত্মঘাতী হামলার বিবরণ পোস্ট করতেন।
গত মাসে কাবুলের পতনের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলন না করা পর্যন্ত তার কোনো ছবি জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি। তাছাড়া, কয়েক বছর ধরে আমেরিকান সামরিক গোয়েন্দারা বিশ্বাস করত যে তালিবানের মিডিয়া অপারেশন আদতে বেশ কয়েকজন পরিচালনা করতেন এবং তাদের মধ্যে মুজাহিদও একজন।
১৯৯৪ সালে যে চারজন মিলে আফগানিস্তানে তালিবান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ তাদের একজন। তিনি সবচেয়ে বেশিদিন ধরে তালিবানের নেতাদের কাউন্সিল বা রেহবারি শুরার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রভাবশালী রেহবারি শুরা তালিবানের নীতিনির্ধারণী ফোরাম হিসেবে পরিচিত।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে তালিবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ জানান, নতুন প্রধানমন্ত্রী মোল্লা হাসান আখুন্দের ডেপুটি হিসেবে অর্থাৎ উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করবেন তালিবানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার।
আলজাজিরা বলছে, তালিবানের প্রতিষ্ঠাতা নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের সান্নিধ্য পাওয়ার কারণেই গ্রুপটির অন্যান্য সদস্যদের কাছে অনেক বেশি সম্মানের পাত্র বিবেচিত হন মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ।
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বর্তমানে মোল্লা আখুন্দের বয়স ষাটের মাঝামাঝি বা এর থেকে কিছুটা বেশি। তাদের দৃষ্টিতে, ধর্মীয় ব্যক্তি হিসেবে যতটা তার চেয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মোল্লা আখুন্দের প্রভাব ও ভূমিকা বেশি। তালিবানের শীর্ষ নেতৃত্ব ও কাউন্সিলের ওপর আখুন্দের প্রভাবের কারণে সামরিক বিষয়াদিতেও তার মতামত বড় ধরনের গুরুত্ব বহন করে।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শাহ দুররানির পশতুন বংশধর মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দুররানি আধুনিক আফগানিস্তান গড়ে তুলেছিলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানের উচ্চস্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন যে তালিবানরা তাদের কেউ কেউ বড় রকমের সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লিখিয়ে এসেছে পূর্বেই। এমন পরিস্থিতিতে আফগানের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি করুণ হবার আশঙ্কাই বেশি বলে মনে করছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৮
আপনার মতামত জানানঃ