মার্কিন আগ্রাসনে গত দুই দশকে প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। আর এসব আগ্রাসন পরিচালনার জন্য খরচ হয়েছে আট ট্রিলিয়ন ডলার। আমেরিকার ব্রাউন ইউনিভার্সিটি থেকে ‘কস্টস অব ওয়ার প্রজেক্ট’ নামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার অপমানজনক ও বিপর্যয়কর বিদায়ের পর রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়।
এতে বলা হয়েছে, দুই দশকে সরাসরি আগ্রাসনে নিহত হয়েছে ৯ লাখ ২৯ হাজার মানুষ। এ সময় প্রায় ৮০টি দেশে আমেরিকা বোমা হামলা ও গোলাবর্ষণ করেছে অথবা সরাসরি যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক নম্বর বিশ্বশক্তি হিসেবে গ্রেট ব্রিটেন অপসারিত হয় এবং তার স্থলাভিষিক্ত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এই ঘোষণা প্রথম প্রকাশ্যে দেন জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর এটম বোমা নিক্ষেপ করে।
সাম্রাজ্যবাদীরা স্ট্যালিনকে ও সেই সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নকে গণহত্যাকারী, ক্রিমিনাল ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে তাদের প্রচারণা চালিয়ে গেলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অদৃষ্টপূর্ব গণহত্যার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশাল আকারের গণহত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয় না।
অথচ জাপানে এটম বোমা নিক্ষেপ করে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে লাখ লাখ নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজ আমেরিকা এমন সময় করেছিল যখন ১৯৪৫ সালের মে মাসে ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল এবং জুলাই মাসের দিকেই জাপান আত্মসমর্পণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল।
যেহেতু শুধু হিটলারই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বর্ণবাদী, এজন্য তারা এটম বোমা জার্মানিতে নিক্ষেপ না করে সেটা নিক্ষেপ করেছিল জাপানে। এভাবে নিষ্প্রয়োজনে এটম বোমা নিক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্ট্যালিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে হুমকি দিয়ে বোঝানো যে, যুদ্ধ শেষ হলেও পরবর্তী শান্তি চুক্তিতে আমেরিকার শক্তিকে তারা যেন হিসাবের মধ্যে রেখে আলাপ-আলোচনা করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে নিজের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য দেশে দেশে, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর তাদের আক্রমণ শুরু করে। শুধু সামরিক নয়, অন্য সব উপায় অবলম্বন করেই তারা এ কাজ শুরু করে।
সেই থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে নিজের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য দেশে দেশে, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর তাদের আক্রমণ শুরু করে। শুধু সামরিক নয়, অন্য সব উপায় অবলম্বন করেই তারা এ কাজ শুরু করে।
প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের কুখ্যাত বিদেশ সেক্রেটারি ডালেসের আমলে এই সাম্রাজ্যবাদী নীতি আইনে পরিণত অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। তারা সিয়াটো, বাগদাদ চুক্তি, সেন্টো ইত্যাদির মাধ্যমে বেশ পরিকল্পিতভাবেই এক্ষেত্রে অগ্রসর হয়।
প্রথম থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে সরাসরি সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এলেও পরবর্তীকালে তারা এর সঙ্গে যুক্ত করে তাদের ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ নীতি। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকেই এর শুরু।
এর জন্য প্রথমে তারা আফগানিস্তানে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বিন লাদেনকে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতা হিসেবে খাড়া করে। পরে তারা তৈরি করে তালিবানদের। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য করার পর বিন লাদেন এবং আফগানিস্তানে তালিবান শাসকদের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে নানা কারণে।
এর আগে অবশ্য বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গত ২০ বছরে দুই লাখ কোটি ডলার খরচ হয়েছে।
নতুন গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯/১১ পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট বাজেট খরচ এবং ভবিষ্যতের বাধ্যবাধকতা ব্যয় প্রায় আট লাখ কোটি ডলার। এর মধ্যে দুই লাখ ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি খরচ করেছে মার্কিন সামরিক দপ্তর পেন্টাগন, এক লাখ ডলার দেওয়া হয়েছে সুদ হিসেবে এবং ২০৫০ সাল পর্যন্ত হতাহত সেনাদের ভবিষ্যত স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় হিসেবে খরচ হবে দুই লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে ৯ লাখ ২৯ হাজার মানুষ।
৯/১১ পরবর্তী কোনো মার্কিন সরকারই যুদ্ধের ব্যয় নিয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘৯/১১ পরবর্তী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সরকারই মোট ব্যয় হিসাব করেনি।
কস্টস অফ ওয়ার-এর সহকারী পরিচালক ক্যাথেরিন লুৎজ বলেন, আমেরিকার যুদ্ধ ছিল দীর্ঘ, জটিল এবং ব্যর্থ। দুই দশকের যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্য, মিত্র জোটের সেনা, বিরোধীপক্ষের যোদ্ধা, বেসামরিক নাগরিক, সাংবাদিক এবং মানবিক ত্রাণ কর্মী।
তবে যুদ্ধের পরোক্ষ কারণে যে সমস্ত মানুষ মারা গেছেন তাদের সংখ্যা এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি।
আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান এবং সিরিয়ায় পরিচালিত আগ্রাসনে আমেরিকা আট ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এর মধ্যে ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে আগ্রাসন পরিচালনার জন্য।
ক্যাথেরিন লু্ৎজ বলেন, মার্কিন কেন্দ্রীয় বাজেটের বিরাট বড় অংশ পেন্টাগন এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীতে খরচ করা হয় কিন্তু আমেরিকার জনগণ তা জানে না।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সারাবিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে আসছে এবং তারা যে বলদর্পী আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছে এতে পুরো বিশ্ব ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে চলে গেছে। মানবাধিকার রক্ষার নামে আমেরিকা দেশে দেশে যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে তাতে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সামরিক বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে না বরং বিপুল সংখ্যায় বেসামরিক নাগরিক মারা যাচ্ছে এবং প্রচুর পরিমাণে সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আমেরিকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার মধ্যদিয়ে স্বার্থপরতা এবং কপটতার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৮
আপনার মতামত জানানঃ