তীব্র খাদ্য সংকটে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা। বেসরকারি ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রাশূন্য হয়ে পড়ায় আমদানিতে অর্থায়ন করতে পারছে না। এ অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার দেশটির সরকার খাদ্য সংকট মোকাবেলায় জরুরি অবস্থা জারি করে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রা ফুরিয়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খাবার আমদানিও করতে পারছে না দেশটি। কঠিন অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে দেশটি।
মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) লঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে জানিয়েছেন, চিনি, চালসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য মজুদ ঠেকাতে তিনি জরুরি আইন কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন। এর ফলে সরকারি কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের মজুত করা খাদ্য জব্দ, মজুতকারীকে গ্রেপ্তার ও সরকার পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা পেল।
ধান, চাল, চিনি এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের সরবরাহের সমন্বয় করার জন্য রাজাপাকসে একজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাকে অপরিহার্য পরিষেবার কমিশনার জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
আল জাজিরার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শ্রীলঙ্কায় সম্প্রতি চিনি, চাল, পেঁয়াজ ও আলুর মতো খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এছাড়া করোনাভাইরাস আতংকের মধ্যেই গুঁড়াদুধ, কেরোসিন তেল ও রান্নার গ্যাসের জন্য দোকানগুলোর সামনে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। ধান, চাল, চিনি থেকে শুরু করে শাক-সবজি, এমনকী দুগ্ধজাত পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এমনকী কেরোসিন তেল বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। তাও সব জায়গায় কেরোসিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাস সিলিন্ডারের দামও আকাশছোঁয়া।
পরিস্থিতিকে আরও ঘোরাল করে তুলেছে কালোবাজারি। পণ্য মজুত রেখে বাজারে বেশি দামে তারা বিক্রি করতে শুরু করেছে। সরকার এই সব কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিলেও দেশের সার্বিক চিত্রের কোনও পরিবর্তন হয়নি। দোকানের সামনে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। লাইন শেষ হওয়ার আগেই জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিক্রি শেষ। ফলে সকাল থেকে লাইন দিলেও অনেকে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে দেশটিতে ১৬ দিনের কারফিউ জারি করা হয়েছে, যা শেষ হবে আগামী সোমবার। সেখানে এখনো প্রায় প্রতিদিন করোনায় দুই শতাধিক মানুষ মারা যাচ্ছেন। এরপরও বাধ্য হয়েই দোকানের সামনে ভিড় করছেন সাধারণ লোকজন।
দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী বান্দুলা গুনাবর্ধনে বলেছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যপণ্য মজুদ করার ফলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে করে জনসাধারণের অসুবিধা হচ্ছে। সরকার খাদ্য মজুদ করার জন্য জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়েছেন বলে জানান তিনি।
খাদ্য মজুদ করার শাস্তি বৃদ্ধির পরেও খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে দেশটিতে। মূলত মহামারির কারণে শ্রীলঙ্কায় এই খাদ্যের সংকট তৈরি হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কায় ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল রেকর্ড ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এসময় তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ঘাটতি দেখা দেয়। ২০১৯ সালে যেখানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সাড়ে সাতশ কোটি ডলার, তা কমতে কমতে চলতি বছরের জুলাইয়ে এসে দাঁড়ায় মাত্র ২৮০ কোটি ডলারে।
এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে গত বছরের মার্চ মাসে গাড়ি, ভোজ্যতেল, হলুদসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে লঙ্কান সরকার। স্থানীয় আমদানিকাররা জানিয়েছেন, তারা ডলার জোগাড় করতে না পারায় খাদ্য-ওষুধের মতো অনুমোদিত পণ্যও কিনতে পারছেন না। লঙ্কান জ্বালানিমন্ত্রী উদয় গামনপিলা গাড়িচালকদের কম জ্বালানি তেল ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়েছেন, যেন সেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও টিকা কেনা যায়।
এদিকে এই কঠিন মুহূর্তে শ্রীলংকার পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কাকে মোট ২০ কোটি ডলার দিতে চেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রথম দফায় গত ১৯ আগস্ট পাঁচ কোটি ডলার দেওয়া হয়। এবার পাঠানো হয়েছে আরো ১০ কোটি ডলার।বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, নিউইয়র্কের ফেডারেল ব্যাংক থেকে রিজার্ভে থাকা অর্থ থেকে শ্রীলঙ্কার জন্যে ছাড় দেয়া হয়।
তবে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া এই সাহায্য সরাসরি অনুদান কিংবা ঋণ নয়। ২০ কোটি ডলারের বদলে শ্রীলঙ্কা সমপরিমাণ রুপি বাংলাদেশকে দেবে। এর সঙ্গে কিছু সুদও পাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটিকে বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ’ নীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ