আবহমানকাল থেকে এই জনপদে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল শত শত নদ-নদী। কিন্তু ভারতের নদীশাসন, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে উত্তরাঞ্চলের ২ হাজার কিলোমিটার হারিয়ে যাওয়া নদীপথ আর ফিরে পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে ১৬ জেলায় মাত্র ৪০০ কিলোমিটার নৌপথ কোনোরকমে টিকে রয়েছে।
ভারতের নদীশাসন, তীব্র খরা, শীত মৌসুমে প্রচন্ড ঠান্ডা, প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত, অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও দখলসহ নানা কারণে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর প্রবাহ থমকে গেছে। গত ৫০ বছরে ছোটবড় ৩ শতাধিক নদ-নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে কোনোরকমে বেঁচে থাকা নদ-নদীগুলো যৌবন হারিয়ে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে কৃষি, জনস্বাস্থ্য, প্রাণী ও উদ্ভিদ হুমকির মুখে।
নদীবিষয়ক গবেষক ও লেখক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, উত্তরের ১৬ জেলায় একসময় ছোটবড় ৪ শতাধিক নদ-নদী ছিল। এর মধ্যে ৩ শতাধিক নদ-নদীর প্রবাহ থমকে গেছে। হারিয়ে যাওয়া ৩ শতাধিক নদ-নদীতে জলপথ ছিল ২ হাজার কিলোমিটারের ওপর। এ জলপথ এখন রূপান্তরিত হয়েছে স্থলভূমিতে। বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটি নদ-নদী দিয়ে নৌযান চলছে। সেগুলো হলো ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, পদ্মা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ফুলজোড়, বড়ালের ভাটির অংশ ও বর্ষা মৌসুমে আত্রাই। এসব নদ-নদীর মাত্র ৪০০ কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের নদ-নদী দিয়ে বয়ে চলা প্রাণের প্রবাহ থেমে যাচ্ছে। এসব নদ-নদী, উপনদী, শাখা নদী, প্রশাখা নদী, ছড়া নদী, নালা নদী ও নদী খাত এখন শুধুই এ অঞ্চলের মানুষের স্মৃতি।
স্থানীয়রা জানান, শুকনো মৌসুমে তিস্তায় থাকে হাঁটুপানি। ডালিয়া থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল চর। বগুড়ার প্রমত্তা করতোয়া এখন খালে পরিণত হয়েছে। তেমনি গাইবান্ধার ঘাঘট, কুড়িগ্রামের ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদ শুকনো মৌসুমে হেঁটে পার হওয়া যায়। পদ্মার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এখন নদীর শোঁ শোঁ ডাক দূরের কথা, দুই চোখ যেদিকে যায় শুধু বালু আর বালু। ভারতের ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা শুকিয়ে অনেক স্থানে খালে পরিণত হয়েছে। অথচ উত্তরাঞ্চলের মানুষের একসময় জীবন-জীবিকা নির্ভর করত এ নদীর ওপর।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা অববাহিকা অর্থাৎ রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় ৮০টির বেশি নদ-নদীর প্রবাহ থেমে গেছে। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার ৪০টির বেশি নদ-নদীর প্রবাহ নেই। অর্ধশতাব্দী আগে এসব নদ-নদীতে ছিল পানির প্রবাহ ও প্রাণের স্পন্দন। বর্তমানে অনেক স্থানে এসব নদ-নদীর কোনো অস্তিত্বই দেখা যায় না। এ ছাড়া পদ্মা অববাহিকায়ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট প্রায় ১৪০টি নদ-নদী কালের অতলে হারিয়ে গেছে।
ব্রহ্মপুত্র নদের অবস্থা আরও করুণ। কুড়িগ্রামের চিলমারী এলাকায় শুকনো মৌসুমে এ নদী পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। সূত্রমতে, উত্তরাঞ্চলে প্রবাহ থমকে যাওয়া ৩ শতাধিক নদ-নদীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ধরলা, জলঢাকা, দুধকুমার, তিস্তা, সতী, ঘাঘট, নীলকুমার, বাঙালি, বড়াই, মানাস, কুমলাই, লাতারা, ধুম, বুড়িঘোড়া, সোনাভরা, হলহলিয়া, লোহিত্য, ঘরঘরিয়া, ধরনি, নলেয়া, জিঞ্জিরাম, ফুলকুমার, কাটাখালী, সালমারা, রায়ঢাক, খারুভাঁজ, যমুনেশ্বরী, চিকলী, মরা করতোয়া, ইছামতী, আলাইকুমারী, মরা তিস্তা ইত্যাদি।
সূত্রমতে, একসময় তিস্তার শাখা নদ-নদী হিসেবে ঘাঘট ও মানাস দাপটের সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রকৃতি শাসন করত। এসবের অনেক স্থানে নগরায়ণ হয়েছে। আবার অনেক স্থান পরিণত হয়েছে আবাদি জমিতে। জানা গেছে, গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর, সদর উপজেলা, পীরগাছার প্রায় ৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল মানাস নদ। এ নদের এখন অস্তিত্ব নেই। মানাস নদের মতো উত্তরাঞ্চলের ২ হাজার কিলোমিটার এলাকার শতাধিক নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের কৃষি ক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গভীর-অগভীর নলকূপগুলোয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
নদীরক্ষায় সরকারের নীতি যে কোনো কাজে আসছে না, বিপুল পরিমাণ নদীপথ বিলীন হয়ে যাওয়াটা তারই প্রমাণ। বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে গবেষণার কোনো বিকল্প দেখছেন না। গবেষণার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত কারণ ও চিত্র স্পষ্ট হওয়া দরকার। তারা নদী রক্ষায় আদালতের রায় ও আন্তর্জাতিক নানা কনভেনশনের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
মিই/আরা/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ