সারা পৃথিবী জুড়েই আদিবাসীদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন৷ দেশে দেশে আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের ওপর গণহত্যা, জবর দখল এবং সংঘাতই এর মূল কারণ। এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যও৷ হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা৷
সারা পৃথিবীতে প্রায় ৫৫ কোটি আদিবাসী আছে। আদিবাসী ভাষা আছে ৭ হাজার। আছে প্রায় ৫ হাজার ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। প্রচলিত ভাষার মধ্যে বর্তমানে ২ হাজার ৬৮০ টি আদিবাসী ভাষা ‘ডেঞ্জার জোনে’ আছে অর্থাৎ বিলুপ্তির পথে।
প্রসঙ্গত, যে ভাষায় ১ হাজারের কম লোক কথা বলে, ওই ভাষা বিলুপ্তির পথে আছে বলে চিহ্নিত করা হয়। গত শতাব্দীতে প্রায় ৬০০টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই শতাব্দিতেও যদি অবস্থার পরিবর্তন না হয়, তবে প্রায় ৯৫ শতাংশ ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ বা এমআরসি সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়ে বলেছে, বিশ্বের এই সংঘাত পরিস্থিতি চলতে থাকলে ২১১৫ সালের মধ্যে অন্ততল ৭,০০০ আদিবাসী ভাষা পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে৷
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইথিওপিয়া, চীন ও ইরাকে সংঘাত, উচ্ছেদের কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আদিবাসীদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে৷ আর সেইসাথে তাদের সংস্কৃতিও হারিয়ে যেতে বসেছে৷
সংস্থাটির নীতি ও যোগাযোগ পরিচালক কার্ল সোডারবার্গ বলেছেন, যদিও আদিবাসী বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়, তবে বর্তমানে তাদের উপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনার মাত্রা ভয়াবহভাবে বাড়ছে৷
সিরিয়া ও ইরাকে যে যুদ্ধ চলছে তাতে বহু মানুষ গৃহহীন হচ্ছে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু, যেমন ইয়াজিদি এবং সাবিয়ান মাদিয়ানরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস মাইনরিটিস অ্যান্ড ইন্ডেজেনাস পিপলস-এর প্রতিবেদনে এ কথাই তুলে ধরেছেন কার্ল৷
তাই নিজেদের পূর্বপুরুষের বসতি থেকে আদিবাসী সম্প্রদায় নির্মূলের সমূহ আশঙ্কা রয়েছে৷ আশঙ্কা রয়েছে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার, কেননা স্থানভেদে এ সব সংস্কৃতি লালিত হয়৷ ইরাকে সাম্প্রতিক সহিংসতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যেমন ইয়াজিদি, তুর্কি, সাবাক, খ্রিষ্টান এবং কাকাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং গৃহহীন হয়েছে সবচেয়ে বেশি৷
জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, জঙ্গি সংগঠন তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছে ইয়াজিদিদের ওপর৷ তাদের হত্যা করা হয়েছে, বন্দি করা হয়েছে এবং বানানো হয়েছে দাস৷ তাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে বলে গত জুন মাসেও জানিয়েছে জাতিসংঘ৷
সবচেয়ে ভযাবহ হলো, আইএস আদিবাসী এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংস করছে৷ এতে করে আদিবাসীদের সংস্কৃতির পাশাপাশি তাঁদের পরিচিতিও পড়েছে হুমকির মুখে৷ কেননা যখন একটি সম্প্রদায় নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়, তখন তাদের সংস্কৃতি এবং এতিহ্য ধরে রাখাটা ভীষণ কষ্টকর হয়৷ এছাড়া পরবর্তী প্রজন্মে তাদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়াটাও তখন সহজ হয় না৷
সার্বিক বিচারেও ভাষার বৈচিত্র্য খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। ইউনেস্কোর হিসেবে বর্তমানে পৃথিবীতে ২০ জন মানুষ আছেন যাদের ভাষায় কথা বলতে পারেন না আর কেউ। তাদের মৃত্যুর পরই কালের গর্ভে বিলীন হবে ২০টি ভাষা। ১০০ জনের কম মানুষ কথা বলেন এমন ভাষার সংখ্যা ৫৩৪টি।
ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিপন্ন ভাষার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এমন দেশের তালিকায় আছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ। তবে অস্তিত্বের সঙ্কটে থাকা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ভাষা আছে ভারতে। দেশটিতে ঝুঁকিতে থাকা ১৯৭টি কথ্য ভাষার মধ্যে ৪২টি ভাষাই হারিয়ে যাওয়ার পথে। দেড়শ কোটি মানুষের দেশ ভারতে ১০ হাজারেরও কম মানুষ কথা বলেন এসব বিপন্ন ভাষায়।
ভাষার জন্য সংগ্রাম করা খোদ বাংলাদেশেই ঝুঁকিতে আছে বম এবং বিষ্ণুপ্রিয়সহ মোট ৫টি ভাষা। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহসহ কয়েকটি অঞ্চলে বাস করেন অন্তত ৩০ লাখ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের সমীক্ষার অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪১টি ভাষা রয়েছে তার মধ্যে ৩৪টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা। এরমধ্যে হাতে গোনা কয়েকটির লিখিত রূপ আছে।
খাসি, বম, সাঁওতালসহ কোন কোন ভাষা ইংরেজির মতো রোমান হরফে, হাজং, মালতোসহ কয়েকটি ভাষা বাংলা হরফে আবার চাকমা, মারমা, চাক, মনিপুরী, ম্রো, খেয়াং এমন আরও কয়েকটি ভাষার রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। কিন্তু সেই বর্ণমালায় শিক্ষার সুযোগ তেমন না থাকায় তার ওপর বাংলা ভাষার চাপের কারণে তাদের নিজস্ব ভাষাগুলো মৌখিকভাবে চর্চা হলেও এর লিখিতরূপ হারাতে বসেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯১৩
আপনার মতামত জানানঃ