বাংলাদেশে যেকোনো সাম্প্রদায়িক ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হলেও, হয় না বিচার৷ ফলে থামছে না এ ধরণের ঘটনা৷ এবার দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় খুলনার রূপসা উপজেলার শিয়ালী গ্রামে গত শুক্র ও শনিবার চারটি মন্দির, ছয়টি দোকান এবং দুইটি বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে; মামলাও হয়েছে।
প্রশাসন থেকে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করা হয়েছে। রূপসা থানার পুলিশ বলছে শনিবার রাতেই এ নিয়ে একটি মামলা হওয়ার পর গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনায় দশ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে মামলাটিতে কাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং কাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা স্পষ্ট করেনি পুলিশ।
সূত্র মতে, ওই এলাকায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন রয়েছে। রূপসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সরদার মোশাররফ হোসেন বলছেন, এলাকার পরিস্থিতি শান্ত আছে।
গ্রামটির হিন্দু অধিবাসীরা বলছেন, হামলকারীরা অন্তত চারটি মন্দির এবং ভেতরে থাকা প্রতিমা ভাংচুর করেছে। পুলিশ অবশ্য হামলার শিকার হওয়া মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনার সংখ্যা নিশ্চিত করেনি বিবিসিকে।
শিয়ালি পুরাতন জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা নাজিম উদ্দিন বলেন, ৬ আগস্ট (শুক্রবার) এশার নামাজ চলাকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষ ও নারীরা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মসজিদের সামনে দিয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। এ অবস্থায় বের হয়ে নামাজের সময় তাদের শব্দ না করার জন্য অনুরোধ করি। তখন তাদের একজন আমাকে ধাক্কা দেন।
তিনি আরও বলেন, এতে মুসল্লি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। রাতেই সে ঘটনা শেষ হয়ে যায়। এরপর কে বা কারা বিভিন্ন জায়গায় ভাঙ্গচুর চালায়।
পূজা উদযাপন পরিষদ রূপসা উপজেলার সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণ গোপাল সেন বলেন, হামলায় চারটি মন্দিরের ১০টি প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। এলাকায় এখন চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। প্রশাসন সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তৎপর রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ৬ আগস্ট রাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নামসংকীর্তনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র এ হামলার ঘটনা ঘটে। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ইমামের ওপর কোনও হামলা করেনি।
স্থানীয়রা জানান, শেখপুরা, বামনডাঙ্গা এবং চাঁদপুর এলাকার শতাধিক যুবক সংঘবদ্ধভাবে শনিবার সন্ধ্যায় শিয়ালি মহাশ্মশান মন্দিরে হামলা চালায়। তারা সেখানকার প্রতিমা এবং শ্মশানের যাবতীয় উপকরণ ভাঙচুর করে। এরপর তারা শিয়ালি পূর্বপাড়া এলাকায় হামলা চালায়। এসময় পূর্বপাড়ার হরি মন্দির, শিয়ালি পূর্বপাড়া দূর্গা মন্দির এবং শিবপদ ধরের গোবিন্দ মন্দিরের সব প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়।
জানা যায়, দুর্বৃত্তরা স্থানীয় শিবপদ ধরের বাড়িতে হামলা চালায়। এরপর হামলাকারীরা বলাই মল্লিকের দোকান ও বাড়ি, অনির্বাণ হীরার চায়ের দোকান, প্রিতম মজুমদারের মেশিনারিজের দোকান, গনেশ মল্লিকের ওষুধের দোকান, শ্রীবাস মল্লিকের মুদি দোকান এবং সৌরভ মল্লিকের মুদি দোকান ভাঙচুর করে।
রূপসার ইউএনও ও থানার ওসি দুজনেই বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় মসজিদে নামাজ চলার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা ‘গান-বাজনা’ করছিলেন অভিযোগে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় যেটাকে তারা ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বলে বর্ণনা করছেন। তবে রূপসা উপজেলার নির্বাহী অফিসার বলছেন, ওই দ্বন্দ্বের সমাধান সেদিনই হয়ে গিয়েছিল এবং ঐদিনের ঘটনার সাথে শনিবারের হামলার সম্পর্ক নেই।
ইউএনও রুবাইয়া তাছনিম বলেন, শুক্রবারের ঘটনার পরপরই প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনি স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আমরা জেলা প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা সাথে সাথে সেখানে যাই এবং স্থানীয়দের সাথে বৈঠক করে দ্বন্দ্বের মিটমাট করি।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গত বছরের অক্টোবরে সাতমাসে সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি জরিপ প্রকাশ করে৷ তাতে বলা হয় গত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর এই সাত মাসে ৬০টি পরিবারকে গ্রামছাড়া করা হয়েছে৷ মন্দিরে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ২৩টি ঘটনা ঘটেছে৷ ওই সময়ে হত্যার শিকার হয়েছেন ১৭ জন সংখ্যালঘু৷ হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ১১ জনকে৷ ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩০ জন৷ অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৩ জন৷
২৭টি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে৷ বসতভিটা, জমিজমা, শ্মশান থেকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি৷ সাতজনকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে চারজনকে৷ বসত-ভিটা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৮৮টি৷ হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন ২৪৭ জন৷
তাদের হিসাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় মামলার হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ৷ অনেক ঘটনায় মামলাও করা যায় না৷ আর বিচার পাওয়ার হার সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ৷
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/০৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ