ছয় মাস আগের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই মিয়ানমার একটা অস্থির সময় পার করছে। জান্তা সরকার একদিকে যেমন দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আর এজন্য দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সামরিক শাসনবিরোধী সামাজিক শক্তি সিডিএম-কে (সিভিল ডিজওবিডিয়েন্স মুভমেন্ট) অন্তরীণ করে রেখেছে।
তবে আজ রোববার ২০২৩ সালে জরুরি অবস্থা তুলে নিয়ে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সামরিক জান্তা। সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া জেনারেল মিন অং হ্লাইং দেশটিতে দুই বছর পর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে এই ঘোষণা দেন।
রোববার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যালেনে দেওয়া এক ভাষণে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং বলেন, ২০২৩ সালের আগস্টের মধ্যে মিয়ানমারের জরুরি অবস্থা তুলে নিয়ে সাধারণ নির্বাচন দেওয়া হবে। এ সময় নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করতে পারবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন।
এর আগে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে দেশটির গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সাং সু চিকে আটক করে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং।
এরপর থেকে দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে সামরিক জান্তা সরকারের আইন শৃঙ্খলারক্ষী বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে ৯ শতাধিক আন্দোলনকারী প্রাণ হারিয়েছেন। সেই সঙ্গে কয়েক লাখ মিয়ানমারবাসী বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) হাজার হাজার শীর্ষস্থানীয় নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করে সামরিক শাসনবিরোধী শক্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট-কে (এনইউজি) পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে আখ্যায়িত করে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে। এত কিছুর পরও জান্তা সরকারের চলার পথ খুব একটা মসৃণ নয়। তা হঠাৎই তাদের এই নির্বাচনের ঘোষণায় স্পষ্ট হয় — এর পেছনে আন্তর্জাতিক চাপের ভূমিকা অনেক। কারণ মিয়ানমারের সেনাশাসকরা ক্রমাগতভাবে একটি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরোধিতা করে যাচ্ছে। এসব চাপ সামলাতেই দুই বছর পর নির্বাচনের ঘোষণা দিল জান্তা সরকার।
এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা টালমাটাল অবস্থা জান্তা সরকারের। গত মাসের শুরুতে মিয়ানমার সামরিক জান্তার ওপর আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এ দফায় ৪ মন্ত্রীসহ ২২ জনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি ৪টি কোম্পানিকেও যুক্তরাষ্ট্র কালো তালিকাভুক্ত করেছে বলে রয়টার্সের সূত্র মতে জানা যায়।
এই দফায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন মিয়ানমার জান্তার তথ্যমন্ত্রী চিট নাইং, বিনিয়োগমন্ত্রী অং নাইং ও, শ্রম ও অভিবাসন মন্ত্রী মিন্ট কিয়ায়িং এবং সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রী থেট থেট খাইন। দেশটির প্রভাবশালী স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের তিন সদস্যও রয়েছেন নিষেধাজ্ঞার তালিকায়।
এছাড়া কর্মকর্তাদের স্ত্রী-সন্তানসহ আরও ১৫ জনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে মার্কিন প্রশাসন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি, মার্চ এবং মে মাসে কয়েক দফায় মিয়ানমার জান্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তারা।
এছাড়া কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ওয়ানবাও মাইনিং লিমিটেড এবং তার দুটি শাখা প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার ওয়ানবাও মাইনিং কপার লিমিটেড ও মিয়ানমার ইয়াং সে কপার লিমিটেডকে। কালো তালিকায় ঢোকা অন্য কোম্পানিটি হচ্ছে কিং রয়েল টেকনোলজিস লিমিটেড।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এক বিবৃতিতে বলেন, এই নিষেধাজ্ঞায় মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি। বরং দেশটিকে দ্রুততম সময়ে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে নিতে সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরোধিতা করে যাচ্ছে। মিয়ানমার প্রশ্নে আসিয়ান (দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতি সংস্থা) যদিও খুব একটা সফল হয়নি, তবুও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ বৈঠক করেছে। এ বৈঠক থেকে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা দেশগুলোসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। এমনকি মিয়ানমারের সঙ্গে অতীতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এমন রাষ্ট্রও এ অভ্যুত্থানকে মেনে নেয়নি। সিঙ্গাপুর তাদের মধ্যে অন্যতম। এরূপ নানামুখী চাপ ছাড়াও জাতিসংঘের থার্ড কমিটি, সাধারণ পরিষদসহ বিভিন্ন পর্যায়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ