ইরাকে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের সময় দেশটি থেকে লুট করে নেয়া সুমেরীয় ভাষায় লিখিত প্রাচীন মহাকাব্য গিলগামেশের ছত্র লিপিবদ্ধ তিন হাজার পাঁচ শ’ বছরের পুরনো একটি কাদামাটির ফলকসহ প্রায় ১৭ হাজার প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন ফেরত দিচ্ছে দখলদার যুক্তরাষ্ট্র।
গতকাল বুধবার (২৮ জুলাই) ইরাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান নাজিম এই কথা জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতিতে জানান, ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রীয় দূতাবাসের সহায়তায় ইরাকি কর্তৃপক্ষের মাসের পর মাস প্রচেষ্টার ফল হিসেবে এই নিদর্শন ফেরত আসছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ফেরত আসা এই নিদর্শনগুলো বেশিরভাগই সুমেরিয়ান যুগে বাণিজ্যিক লেনদেনের প্রমাণ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে সাক্ষাৎ শেষে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা আল-কাজেমি বৃহস্পতিবার দেশে ফিরে যাওয়ার সময় এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সাথে নিয়ে যাচ্ছেন বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে নাজিম বলেন, ‘আমি আশা করি নিকট ভবিষ্যতে আমাদের বাকি সম্পদ বিশেষ করে ইউরোপ থেকে উদ্ধার করবো।’
সোমবার হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা আল কাধিমি। বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো ওয়াশিংটনে সফর করলেন তিনি। তার এই সফরের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দেয়া।
এই কাজে তিনি বেশ সফল হয়েছেন বলা চলে। কারণ তার সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ ইরাকে মার্কিন বাহিনী তাদের যুদ্ধের মিশন শেষ করবে। কাধিমি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে।
বাইডেন বলেছেন, ইরাক থেকে চলতি বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ মিশন শেষে করে সেনারা দেশে ফেরার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরাকের মধ্যে সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে। মার্কিন বাহিনী তাদের মিশন শেষ করলেও ইরাকি বাহিনীকে আত্মরক্ষার কাজে প্রশিক্ষণ, উপদেশ ও পরামর্শ দেয়া অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বাইডেন বলেন, ‘ইরাকে আমাদের ভূমিকা থাকবে…প্রশিক্ষণ, সহায়তা এবং আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করা। কিন্তু চলতি বছরের শেষ নাগাদ আমরা আমাদের যুদ্ধের মিশন শেষ করতে যাচ্ছি।’
২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনকে উৎখাত এবং তার ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংসের অজুহাতে ইরাকে আগ্রাসন শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিদেশি বাহিনী। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ‘স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ ইরাকের’ প্রতিশ্রুতি দিলেও দেশটি নিমজ্জিত হয় রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক বিভাজনে।
ইরাকে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের পর ১৮ বছর যুদ্ধ ও সহিংসতা চলে আসছে দেশটিতে। দীর্ঘ যুদ্ধে অস্থিরতার সুযোগে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার কেন্দ্রভূমি এই দেশটির প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধে দেশটির প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানসমূহে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় এবং বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন লুট করা হয়।
বার্তা সংস্থা এএফপির কাছে এক সাক্ষাতকারে বসরা জাদুঘরের পুরাতত্ত্ব ও ঐতিহ্য বিষয়ক পরিচালক কাহতান আল-ওবায়েদ বলেন, ‘এটি গণনা করা অসম্ভব যে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানসমূহ থেকে কী পরিমাণ সম্পদ লুট করা হয়েছে।’
ফেরত আসা ইরাকি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে সুমেরীয় ভাষায় লিখিত প্রাচীন মহাকাব্য গিলগামেশের ছত্র লিপিবদ্ধ তিন হাজার পাঁচ শ’ বছরের পুরনো একটি কাদামাটির ফলক রয়েছে। এর আগে এটি ওয়াশিংটনের মিউজিয়াম অব বাইবেলে প্রদর্শনের জন্য রাখা হলেও ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত তা মিউজিয়ামটি থেকে বাজেয়াপ্ত করে নেয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে সফর শেষে ইরাকি প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পরই ইরাকের রাজধানী বাগদাদের গ্রিন জোনে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের কাছে দুই দফা রকেট হামলা চালানো হয়েছে। ইরাকের একটি নিরাপত্তা সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে ওই হামলায় কোনও ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকালে ওই হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে এএফপির এক প্রতিবেদনে নিশ্চিত করা হয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই ইরাকে মার্কিন অবস্থান লক্ষ্য করে হামলার ঘটনা ঘটছে। এসব হামলার জন্য ইরানপন্থি বিভিন্ন সংগঠনকে দায়ী করা হচ্ছে। ইরাকে বর্তমানে ২ হাজার ৫শ মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে, যারা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অবশিষ্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে স্থানীয় সেনাদের সহায়তায় ভূমিকা রাখছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৮
আপনার মতামত জানানঃ