বিশ্বে করোনার আগমনের পর থেকে যে কোনো কারণেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া কঠিনতর হয়ে উঠেছে। অভিবাসনপ্রার্থী মানুষের জন্য প্রায় আরও অসম্ভব হয়ে উঠেছে অনুমোদন পাওয়া। এজন্য অনেকেই ঝুঁকছে অনৈতিক প্রক্রিয়ায় অভিবাসনের প্রতি। এতে ফাঁদে পড়ছেন অনেকে। মানব পাচারকারীর লক্ষ্যবস্তু হিসেবে সহজেই পড়ে যাচ্ছেন এসব ব্যক্তিরা।
৩০ জুলাই বিশ্ব মানব পাচারবিরোধী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ইউনাইটেড নেশনস নেটওয়ার্ক অন মাইগ্রেশনের (বিডিইউএনএনএম) অধীনে কাউন্টার ট্রাফিকিং ইন পার্সন টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ (সিটিআইপিটিডব্লিউজি) ওয়েবিনারের আয়োজন করে গতকাল বুধবার। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ক্ষতিগ্রস্তদের কণ্ঠস্বর পথ দেখায়’।
ওয়েবিনার বিশেষ ব্যক্তিদের মতামত
ওয়েবিনারে বিডিইউএনএনএমের সমন্বয়ক এবং আইওএম বাংলাদেশের মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি বলেন, মানব পাচার হলো এমন একটি অপরাধ, যা অভিবাসী শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্যে ঠেলে দেয়। ফলে তারা হয়রানি, জোরপূর্বক শ্রম, অবৈধ বিবাহ, অবৈধ বাণিজ্য ও জীবন হারানোর মতো ঝুঁকিতে পড়েন।
ওয়েবিনারে আরও বলা হয়, বিপদে থাকা অভিবাসীরা প্রায়ই পাচারকারীদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকেন। অনেকেই পাচারের শিকার হয়ে ঋণগ্রস্ত হন। জোরপূর্বক শ্রম, যৌন নির্যাতন, বিয়ে ও আধুনিক দাসত্বের মতো পরিস্থিতির শিকার হন তারা। বাংলাদেশ মানব পাচারের শিকার নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য উৎস ও ট্রানজিট দেশে পরিণত হয়েছে।
এ সময় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, মানব পাচার একটি মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করে এর বিরুদ্ধে সক্রিয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। অভিবাসীদের পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
ওয়েবিনারে উপস্থাপিত নিবন্ধে বলা হয়, করোনার প্রভাবে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে চার লাখের বেশি প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরেছেন। এরপর ৭০ শতাংশ কর্মী কাজ পেতে সমস্যায় পড়ছেন। মানব পাচারের শিকার হয়ে বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রতিবছর আনুমানিক সাত লাখ বাংলাদেশি বিদেশে অভিবাসনকালে যে ঝুঁকির সম্মুখীন হন, তার ওপরও আলোকপাত করা হয়।
মানব পাচার সংক্রান্ত মামলার বিচারের ধীর গতি অন্যতম সমস্যা
২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে সংঘবদ্ধভাবে মানব পাচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছরের কারাদণ্ড ও অন্যূন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। বিধান থাকলেও মানব পাচার সংক্রান্ত মামলার বিচার কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে পাচারকারীদের দমন করা সম্ভব হচ্ছে না।
উচ্চ আদালতের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মানব পাচার সংক্রান্ত মোট ৫ হাজার ৯৯ মামলার মধ্যে ৪ হাজার ৮৫১টি মামলাই রয়েছে বিচারাধীন। নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯০টির। ৫৮টি মামলা বদলি করা হয়েছে। এছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৩টির বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে ন্যায়বিচার প্রশ্নে বিচারপ্রার্থীদের মনে হতাশা সৃষ্টি হয়।
২০১৫ সালের ১ মে থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে অভিবাসীদের গণকবরের সন্ধান মেলে, যেখানে অন্তত ১০ বাংলাদেশির লাশ ছিল। ওই বছর থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে মানব পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার ১৭৫ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনে সরকার।
যে তিন ভাগে সক্রিয়তা প্রয়োজন
মানব পাচার একটি গুরুত্বর অপরাধ। পাচারকারীরা যাতে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে না যায়, সে জন্য আদালত, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে সতর্ক থাকতে হবে। বস্তুত আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ তিন গ্রুপের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
যেমন-তদন্তের ক্ষেত্রে একজন যোগ্য ও সৎ অফিসার যদি স্বাধীনভাবে তদন্ত সম্পন্ন করেন এবং তাকে যদি তার ঊর্ধ্বতন অফিসার নজরদারিতে রাখেন, তাহলে অবশ্যই একটি সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া সম্ভব। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছেন যথাক্রমে পাবলিক প্রসিকিউটর ও বিচারক। এক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটরের আন্তরিকতা ও সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার পাশাপাশি বিচারকার্যে একজন বিচারকের সংবেদনশীলতা অটুট থাকলে দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে তা নিষ্পন্ন হওয়া সম্ভব।
তবে মানব পাচারের দায়ে কাউকে আইনের আওতায় আনার চেয়েও তা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা বেশি জরুরি। এক্ষেত্রে দেশজুড়ে একটি সুরক্ষা বেষ্টনী নির্মাণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকলে মানব পাচার অনেকাংশে কমে আসবে বলে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৩১৯
আপনার মতামত জানানঃ