বকশিশের নামে চাঁদাবাজি করা দেশে এখন পুরনো সংস্কৃতি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপায়ে যা হয়ে আসছে। সামনে কুরবানির ঈদের কারণে রাস্তাঘাটে এখন গরু কিংবা খাসি বোঝাই করা ট্রাকের দেখা মিলছে অহরহ। এইসব ট্রাক থামিয়ে বকশিশের নামে চাঁদাবাজি করার ঘটনাও ঘটছে তেমন অহরহ।
গতকাল শুক্রবার (১৬ জুলাই) মোহাম্মদপুরের বছিলায় তিন রাস্তার মোড়ে গরুবোঝাই একটি ট্রাক আসতেই আটকে দিলেন ১০-১২ জন যুবক মিলে। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠিসোটা। বেশ কয়েকজনের গায়ে ‘মোহাম্মদপুর বছিলা ইজারাদার’ লেখা হলুদ পোশাক পরা। তারা ট্রাক আটকে চাঁদা দাবি করেন। তবে তাদের মতে এটি চাঁদা নয় ‘ঈদের বকশিশ’। ট্রাকচালককে ওই যুবকেরা হুমকি দিয়ে বলেন, ‘বকশিশ দেওয়া ছাড়া ট্রাক যেতে পারবে না।’
সেখানে এভাবে কিছুক্ষণ পর পরই আসছিল ট্রাক। এসব ট্রাকেও লাঠিসোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন ‘হাটের দায়িত্বে থাকা’ যুবকরা। ফলে কয়েকটি ট্রাক মূল সড়কে দাঁড়িয়ে থাকায় তৈরি হয় যানজট। এ সময় ওই যুবকদের সঙ্গে ট্রাকচালক ও গরু ব্যবসায়ীদের বাগবিতণ্ডা করতে দেখা যায়। রাস্তার এতসব ঝামেলার মধ্যেও ট্রাফিক পুলিশককে দেখা যায়নি।
গতকাল শুক্রবার ভোরে ফেনী শহরের সদর হাসপাতাল-সংলগ্ন গরুর হাটে শাহজালাল নামে এক ব্যাপারিকে চাঁদা না দেওয়ায় গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা।
ট্রাকচালকদের দুর্দশার অভিজ্ঞতা
রংপুর থেকে আসা ট্রাকচালক অজি উল্যাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রংপুর থেকে গরু নিয়ে আসার পথে মিঠাপুকুরে হাইওয়ে পুলিশের ফাঁড়ির সামনে ২৫০ টাকা, বগুড়ার নন্দীগ্রামে ১০০ টাকা, সিরাজগঞ্জে ১৫০ টাকা এবং টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় ৫০ টাকা পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া দুটি এলাকায় স্থানীয় মাস্তানদের ৪০০ টাকা দিতে হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি স্থানে পুলিশ টাকার জন্য থামালেও কান্নাকাটি করে রক্ষা পেয়েছি। ভাবছিলাম ঢাকা শহরে চাঁদা লাগবে না, এখন দেখছি এখানেও চাঁদা ছাড়া উপায় নেই।’
মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তার এ মোড়টি পার করেই পৌঁছাতে হয় বছিলার তিনটি অস্থায়ী পশুর হাটে। একেকটি পশুর হাট থেকে মোড়টি সর্বোচ্চ তিন কিলোমিটার দূরে। এখানকার পশুর হাট স্বপ্নধারা হাউজিংয়ে গেলে কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, কোরবানির পশু নিয়ে আসার পথে চাঁদা দিয়েও পরিত্রাণ পাননি তারা। হাটে ঢুকে ভালো জায়গা পেতেও গুনতে হয়েছে বাড়তি অর্থ। এসব অর্থ নিচ্ছেন গরুর হাটে দায়িত্বরত স্থানীয় ‘স্বেচ্ছাসেবীরা’। পশুর হাটটির তত্ত্বাবধানে রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তবে গরু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্বেচ্ছাসেবীদের টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন হাট কর্তৃপক্ষ।
শুধু বছিলা নয়, রাজধানীর আরও বেশ কয়েকটি স্থানে এমন অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দেখা গেছে। পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কঠোর নির্দেশনার পরেও কোরবানির পশু বহনকারী ট্রাকে চাঁদাবাজি চলছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যাপারিরা। কোরবানির পশুবাহী যানবাহন যাতে চাঁদাবাজি বা হয়রানি ছাড়াই নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে গত ১৪ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
থানা পুলিশ, হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশ এবং স্থানীয় মাস্তানদের চাঁদা দিয়েই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা গরুর ট্রাকগুলোকে রাজধানীর হাটগুলোতে ঢুকতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ট্রাকচালকেরা। শুধু রাজধানী নয়, বিভিন্ন জেলায় কোরবানির পশুর হাটে চাঁদাবাজির খবর পাওয়া যাচ্ছে।
কেবল পাড়ার মাস্তানরা নয়, চাঁদাবাজি করছে পুলিশরাও
গাবতলীর হাটে আসা ট্রাকচালক ও ব্যাপারিরাও চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। পশু ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি ঢাকায় আসার পথে মানিকগঞ্জে পুলিশের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন। পুলিশ সদস্যরা ট্রাক আটকে ৫০০ টাকা দাবি করলে ৩০০ টাকা দিয়ে রক্ষা পান এ ব্যবসায়ী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গতকাল শুক্রবার ভোরে গাবতলী হাটে ১৫টি গরু নিয়ে এসেছেন আহম্মদুল হক। তিনি বলেন, ঢাকা পর্যন্ত তাকে ছয়টি স্থানে পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের ২০০ থেকে আড়াইশ টাকা চাঁদা গুনতে হয়েছে। দেবীগঞ্জ থেকে আসা ট্রাকচালক অলি উদ্দিন বলেন, রংপুরের মিঠাপুকুর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে তিনি ২০০ টাকা দিয়েছেন। বগুড়ার নন্দীগ্রামে পুলিশ ট্রাক থামানোর চেষ্টা করলে তিনি দ্রুতগতিতে চলে আসেন।
বছিলা গার্ডেন সিটিতে কুষ্টিয়া থেকে গরু নিয়ে আসা আফসার উদ্দিন বলেন, তিনি একটি ট্রাকে করে বড় মাপের ১৭টি গরু এনেছেন। তাকে ভেড়ামাড়ায় তিনশ টাকা ও টাঙ্গাইলে দুইশ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে।
রাজধানীতে আজ থেকে পশুর হাট
ঈদুল আজহা উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে আজ শনিবার থেকে রাজধানীতে পশুহাট বসার কথা থাকলেও আগেভাগেই বেচাকেনা শুরু হয়েছে। এবার রাজধানী ঢাকায় ১৯টি অস্থায়ী পশুর হাট বসছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ১০টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় ৯টি হাট বসছে।
কয়েকদিন যাবৎ হাট খালি থাকলেও এখন পুরো এলাকা কোরবানির পশুতে ভরে গেছে। তবে এখনও কিছুক্ষণ পর পর দুই-একটি ট্রাক প্রবেশ করছে। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় ক্রেতার সংখ্যা কিছুটা বেশি থাকলেও বিক্রি হচ্ছে কম। দাম সম্পর্কে ধারণা নিয়ে চলে যাচ্ছেন অনেকে। আগামীকাল রোববার থেকে হাট জমবে বলে আশা ইজারাদারদের।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার। ২০২০ সালে খামারি ও কৃষকেরা প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার গবাদিপশু প্রস্তুত রেখেছিলেন। এর মধ্যে ৯৪ লাখ ৫০ হাজার পশু কোরবানি হয়।
ঈদ বকশিশের নামে চাঁদাবাজি নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের। এ নিয়ে গা ছাড়া ভাব দেখানোর জন্য কোরবানির পশু বহন করা ট্রাক চালকদের দুর্দশা আরও বেড়ে যাচ্ছে। দ্রুত এইসব বিষয় প্রশাসনের নজরে আসা উচিৎ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৬১২
আপনার মতামত জানানঃ