লিবিয়ার বন্দিশিবিরগুলোতে অভিবাসনপ্রত্যাশী নারী, পুরুষ ও শিশুরা বর্বর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যৌনতার বিনিময়ে বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়াসহ ভয়াবহ এক পরিস্থিতির শিকার তারা।
আফ্রিকা, এশিয়া মহাদেশ থেকে অনিয়মিত পথে য়ুরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অন্যতম এক রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে লিবিয়া৷ য়ুরোপের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লিবিয়ার কোস্ট গার্ড চলতি বছর দেশটির সমুদ্র পাড়ি দিতে যাওয়া ১৪ হাজার অভিবাসীকে আটক করেছে৷ তাদের বেশিরভাগকেই ফিরিয়ে এনে বন্দিশিবিরগুলোতে আটক রাখা হয়৷ আর সেখানে চলছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা।
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, লিবিয়ার বন্দিশিবিরগুলোতে যৌন সহিংসতাসহ ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২০ ও ২০২১ সালে যেসব অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে য়ুরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে তাদের লিবিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ওই সব বন্দিশিবিরে রাখা হয়েছে।
সেখানেই ওই ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বন্দিরা।।সেখানকার বন্দি কয়েকজন নারী অ্যামনেস্টির কাছে অভিযোগ করেছেন যে, প্রহরীরা যৌনতার বিনিময়ে তাদের বিশুদ্ধ পানি, বিছানা এমনকি ছেড়ে দেয়ার আশ্বাস দেন।
প্রহরীদের দ্বারা বারবার ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন অন্তঃসত্ত্বা আরেক নারী। এমনকি পুরুষ আর কিশোররাও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এক নারী অ্যামনেস্টিকে জানিয়েছেন, বন্দি শিবিরের এক নিরাপত্তারক্ষী তাকে বলেছিল, ‘‘তুমি যদি বিশুদ্ধ পানি এবং বিছানা চাও তাহলে আমার সাথে সহবাস করতে হবে৷’’ তার মতো আরো অনেক নারীই জানিয়েছেন যে পানি, খাবার অথবা মুক্তির আশ্বাস দিয়ে এসব বন্দিশিবিরে নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের ধর্ষণ করেছে৷ অন্তঃসত্ত্বা নারীরাও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
১৪ থেকে ৫০ বছর বয়সী ৫৩ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর সাক্ষাৎকার নিয়ে ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছে অ্যামনেস্টি। নাইজেরিয়া, সোমালিয়া আর সিরিয়ার নাগরিক ওই সাক্ষাৎকারদাতা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনেকেই বন্দি শিবির থেকে পালিয়েছেন। কেউ কেউ টেলিফোনে নিজেদের দুর্দশার কথা জানিয়েছেন।
এক নারী অ্যামনেস্টিকে জানিয়েছেন, বন্দি শিবিরের এক নিরাপত্তারক্ষী তাকে বলেছিল, ‘‘তুমি যদি বিশুদ্ধ পানি এবং বিছানা চাও তাহলে আমার সাথে সহবাস করতে হবে৷’’ তার মতো আরো অনেক নারীই জানিয়েছেন যে পানি, খাবার অথবা মুক্তির আশ্বাস দিয়ে এসব বন্দিশিবিরে নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের ধর্ষণ করেছে৷ অন্তঃসত্ত্বা নারীরাও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
য়ুরোপীয় ইউনিয়ন ও ইতালি দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনুপ্রবেশ আটকাতে লিবিয়ার কোস্টগার্ডদের প্রশিক্ষণ এবং অর্থায়ন করে আসছে৷ এই কোস্টগার্ডরা চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৫ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ভূমধ্যসাগর থেকে লিবিয়ায় ফেরত পাঠিয়েছে৷
এদিকে, পোপ ফ্রান্সিস ও জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বন্দিদের ওপর নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স’র প্রতিবেদন
লিবিয়ার কয়েকটি বন্দিশিবিরে আটক অভিবাসীদের উপর সহিংসতা ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছে ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (এমএসএফ)৷ এমনকি চিকিৎসা সেবাদানকারী আন্তর্জাতিক সংগঠনটি এ কারণে ত্রিপোলির দুইটি জনবহুল বন্দি শিবির থেকে নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷
মাবানি বন্দি শিবিরে গত ১৭ জুন এমএসএফ কর্মীরা ১৯ অভিবাসীকে চিকিৎসা দেন৷ ক্যাম্পের রক্ষীদের নির্যাতনে তাদের শরীরের হাড় ভাঙ্গে গিয়েছিল, কাটা-ছেঁড়া, ক্ষতসহ তারা নানা ধরনের ট্রমায় ভুগছিল৷
এরমধ্যে পায়ের গোড়ালিতে গুরুতর জখমের কারণে হাঁটতে না পারা অভিভাবকহীন এক শিশুও ছিল৷ জানা যায়, মাবানির এই বন্দিশিবিরে দুই হাজারের বেশি অভিবাসীকে রাখা হয়েছে, যা ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি৷
বিবৃতিতে আরেক বন্দিশিবির আবু সালিমের পরিস্থিতিও তুলে ধরেছে এমএসএফ৷ গত ১৩ জুন আটককৃতদের উপর নিরাপত্তারক্ষীদের গুলি চালানোর খবর পেয়ে সংগঠনটির কর্মীরা সেখানে যান৷ কিন্তু গোটা এক সপ্তাহ তাদের ঢুকতে না দিয়ে আহতদের চিকিৎসা সুবিধা থেকে বিরত রাখা হয়৷
এমন পরিস্থিতিতে এই দুই বন্দিশিবির থেকে নিজেদের সেবা কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে এমএসএফ৷ যদিও সিদ্ধান্তটি খুব সহজ ছিল না বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন সংগঠনটির লিবিয়া মিশন প্রধান বিয়াট্রিস ল্যু৷
বেশিরভাগ বন্দিশিবিরেই আলোবাতাস চলাচল বা প্রাকৃতিক আলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেই৷ কিছু শিবির এতটাই জনবহুল যে এক বর্গমিটার জায়গায় চারজনকে থাকতে হয়৷ সেখানেই তাদেরকে শোয়া বা ঘুমাতে বাধ্য করা হয়৷ পাশাপাশি পরিস্কার পানি, স্বাস্থ্যবিধি ও পর্যাপ্ত খাবারের অভাবও রয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘‘অনবরত চলা সহিংসতা, শরনার্থী বা অভিবাসীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা, সেই সঙ্গে আমাদের নিজেদের কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আমরা আর তা মেনে নিতে পারছি না৷’’
এমএসএফ তাদের বিবৃতিতে বলেছে, বেশিরভাগ বন্দিশিবিরেই আলোবাতাস চলাচল বা প্রাকৃতিক আলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেই৷ কিছু শিবির এতটাই জনবহুল যে এক বর্গমিটার জায়গায় চারজনকে থাকতে হয়৷ সেখানেই তাদেরকে শোয়া বা ঘুমাতে বাধ্য করা হয়৷ পাশাপাশি পরিস্কার পানি, স্বাস্থ্যবিধি ও পর্যাপ্ত খাবারের অভাবও রয়েছে৷
এদিকে জুনে বার্তা সংস্থা এপি তাদের এক প্রতিবেদনে শারা-আল-জাওয়াইয়া বন্দিশিবিরে অপ্রাপ্তবয়স্ক আশ্রয়প্রার্থীদের উপর লিবিয়ার নিরাপত্তা রক্ষীদের যৌন নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছে৷
এ বিষয়ে য়ুরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র আনা পিসোনেরো বলেন, লিবিয়ার বন্দিশিবিরে যা ঘটছে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য৷ এইসব বিষয়ে চেষ্টা করেও লিবিয়া সরকারের কোন প্রতিক্রিয়া জানতে পারেনি বার্তা সংস্থা এপি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ