সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের একটি জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এই পোড়ার দেশে শ্রমিকদের পুড়ে মরার ঘটনা নতুন নয়। এর শুরু সেই ১৯৯০ সালে। সে বছর সারাকা গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে শুরু হয় দেশের পোশাক শিল্পের বড় বড় দুর্ঘটনা, ধস ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এরপর কেটেছে তিন দশক। বিচারহীনিতার, প্রতিকারহীনতার তিন দশক।
গত ১৫ বছরে কারখানাগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৩১৭ জন শ্রমিক। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৩৭৪ জন। একটি ঘটনাতেও মেলেনি বিচার। ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে আন্দোলন হলেও কে টাকা পাবে, কত টাকা পাবে তার যৌক্তিক সুরাহা হয়নি। এমনকি দুর্ঘটনার সময় কোন কারখানায় কত শ্রমিক ছিলেন সেটার হিসাবও পাওয়া যায় না। বরং ঘটনা ঘটলেই দায় এড়ানো নানা বক্তব্য পাওয়া যায় মালিকপক্ষ থেকে। প্রতিটি ঘটনাতেই বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা দাবি করেছেন, আগুন লাগার পরপরই কারখানার ফটকে মেরে দেয়া হয় তালা।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশের বিভিন্ন কারখানায় ৪ হাজার ৯৬৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুপুরী কারখানাগুলো
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশের বিভিন্ন কারখানায় ৪ হাজার ৯৬৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে কতটি ঘটনায় মামলা হয়েছে বা সেগুলোর অগ্রগতি কী জানতে চাইলে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। শুধু বড় ও আলোচিত কয়েকটি ঘটনায় হওয়া মামলার খবর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের কাছ থেকে পাওয়া যায়।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০২০ সালে অগ্নিদুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে ১৫৪ জন এবং আহত হয় ৩৮৬ জন। ২০১৯ সালে ১৮৫ জন নিহত ও ৫৭১ জন অগ্নিদুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৪৮৫ জন দুর্ঘটনায় নিহত এবং ৩ হাজার ৮৬৮ জন আহত হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১২৮ জন নিহত ও ৫ হাজার ৮১৭ জন আহত হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ৩৬৫ জন নিহত এবং ১ হাজার ৭৩২ জন আহত হয়েছে।
২০১৮ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ২২ তলা ভবন এফআর টাওয়ারে ২৬ জন নিহত ও আহত হয়েছেন কম পক্ষে ৭৩ জন। একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের বৃহৎ ওয়াহেদ ম্যানসনের দোতলায় মজুদকৃত রাসায়সিক পদার্থের বিস্ফোরণে আগুন লেগে অঙ্গার হলো ৭৯টি তরতাজা প্রাণ। গুরুতর আহত ৪১ জন।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই গাজীপুরের কাশিমপুরের একটি পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে ৫০ জন দগ্ধ হয়। টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীতে ট্যাম্পাকো ফয়েল লিমিটেড নামের একটি ফয়েল পেপার কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে আগুনে দগ্ধ হয়ে ৩৬ জন নিহত ও শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছিলেন।
২০১২ সালে ২৪ নভেম্বর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কারখানার অগ্নিকাণ্ডে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনসে ১১৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। আহত হয় ২০০ পোশাক শ্রমিক। আশুলিয়ার নরসিংহপুরে হামীম গ্রুপের একটি অত্যাধুনিক বহুতল পোশাকশিল্প কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে কর্মরত ২৬ জনের মৃত্যু ও শতাধিক আহত হয়। গাজীপুরের চান্দনায় গরিব এ্যান্ড গরিব সোয়েটার কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেন ২১ জন শ্রমিক।
মহাখালীর একটি নিটিং কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১২ জন শ্রমিক মারা যান যার মধ্যে ১০ জনই ছিলেন নারী শ্রমিক। নরসিংদীর একটি তোয়ালে কারখানার আগুন লেগে ৪৬ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে।
২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে সংঘটিত স্মরণকালের এক ভয়াবহ মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডেই কেড়ে নেয় ১২৫ জন মানুষের প্রাণ। অনেক মানুষ আহতসহ পুড়ে যায় আশপাশের বেশ কটি ভবন।
কেন অহরহ ঘটছে এমন দুর্ঘটনা?
এসব ঘটনায় হেলদোল নেই কর্তৃপক্ষের। নেই বিচার, নেই প্রতিকার। এই যেমন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জুস কারখানায় আগুনে ৫২ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতারের চার দিনের মাথায় হাসেম ফুড বেভারেজের চেয়ারম্যানের দুই ছেলেই জামিন পেয়েছেন।
এই জামিন পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এটিকে হত্যাকাণ্ড বলেছেন, সেখানে চার দিনের মাথায় দুই আসামি কীভাবে জামিন পেলেন?
আগুনে ৫২ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের করা হত্যা মামলায় বুধবার (১৪ জুলাই) বিকালে হাসেম ফুড বেভারেজের চেয়ারম্যানের দুই ছেলে তাওসিফ ইব্রাহিম ও তানজিম ইব্রাহিমকে জামিন দেন আদালত।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান মতে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ১ হাজার ১৮৭টি, ঝুঁকিপূর্ণ ৩ হাজার ৫১৮টি স্থাপনা রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খাতুনের আদালত তাদের জামিনের আদেশ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আদালতের নিবন্ধন কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আসাদুজ্জামান। এই বিচারহীনতা বেপরোয়া করে তুলছে কারখানা মালিকদের।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান মতে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ১ হাজার ১৮৭টি, ঝুঁকিপূর্ণ ৩ হাজার ৫১৮টি স্থাপনা রয়েছে।
এর মধ্যে শুধু রাজধানীতে রয়েছে ১ হাজার ৬৯টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২ হাজার ৫৮৩টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা। ঢাকায় এসব বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় গড়ে উঠেছে অফিস, গার্মেন্টস, শিল্পকারখানা, মার্কেট ও শপিংমল।
এর অনেকগুলোরই সংশ্লিষ্ট সংস্থার বৈধ অনুমোদন নেই। মানা হয় নাই বিল্ডিং কোড। কারখানায় ছোট ছোট কক্ষে বসানো হয় ভারি ভারি যন্ত্রপাতি। অনেক অফিস ও কারখানায় আলাদা গুদাম না থাকায় ভবনের মধ্যেই বিভিন্ন তলায় মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়। কখনো সেখানে থাকে না ওঠানামার জন্য প্রশস্ত সিঁড়ি ও জরুরি বহির্গমনের আলাদা কোনো পথ।
অপরিকল্পিত অপ্রশস্ত সিঁড়ি অগ্নিকাণ্ডের সময় একটি ধোঁয়াভর্তি চিমনিতে রূপ নেয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় মানুষ, যেমনটি এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের বেলায় হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সময় অপ্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে একত্রে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে পদদলিত হয়ে হতাহত হন কেউ কেউ।
ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ৯৩ শতাংশ বহুতল আবাসিক ভবন, বিপণি কেন্দ্র, কলকারখানায় অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই।
তবে গার্মেন্টস কারখানায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক মৃত্যুর পর কারখানা মালিকগণ তাদের প্রতিষ্ঠানে অগ্নিনির্বাপণের কিছু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পর থেকে গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা খুব একটা ঘটছে না। ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ৯৩ শতাংশ বহুতল আবাসিক ভবন, বিপণি কেন্দ্র, কলকারখানায় অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই।
দেশের ৩৫৪টি উপজেলায় অবস্থিত ফায়ার সার্ভিস স্টেশনকে আরো সক্রিয় করে তুলতে হবে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ বিভাগ, ওয়াসা ও তিতাসের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করে সমন্বিতভাবে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে সহায়তা করবে। অগ্নিকাণ্ড ও অগ্নি নির্বাপণের ব্যাপারে ভবনের মালিক ও বৃহত্তর জনগণের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
কোন কারখানায় কত শ্রমিক কাজ করে এর একটি ডাটাবেজ সম্প্রতি করা হলেও সেখানে সব কারখানা যুক্ত হয়নি বলে দাবি শ্রমিক সংগঠনগুলোর। ডাটাবেজে নিয়মিত আপডেট করা প্রয়োজন। সবার এন্ট্রি নিশ্চিত করা উচিত দ্রুততম সময়ে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩১৩
আপনার মতামত জানানঃ