দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিচ্ছে আফগানিস্তান-তালিবান সমীকরণ। ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের ৭০ শতাংশের দখল তালিবানদের হাতে। তারা আবারও নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে দেশটি। আর এই নিয়ে উদ্বিগ্ন বেশ অনেকগুলো দেশ, তবে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ভারত। আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে গত দুই দশকে চারশোরও বেশি সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং বড় বড় কিছু অবকাঠামো প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত। এর পাশাপাশি আফগানিস্তানে তালিবান দখলদারিত্বে চীন-পাকিস্তানের সুবিধাজনক অবস্থান ব্যাকফুটে নিয়ে যাবে ভারতকে।
তালিবানের দখলে ক্ষতির মুখে ভারত
তালিবান দখল নিতে শুরু করায় ভারত পড়েছে হুমকির মুখে। হেরাত, জালালাবাদ এবং মাজার-ই-শরীফের ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো এখনও বন্ধ করা না হলেও, সেগুলোতে কাজকর্ম একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। আফগানিস্তানের কান্দাহার শহরের ভারতীয় কনস্যুলেটে কর্মরত কূটনীতিকদের শনিবার যেভাবে রাতারাতি দিল্লিতে ফিরিয়ে নিয়েছে তাতে ইঙ্গিত স্পষ্ট যে ওই দেশটিতে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিল্লি কতটা উদ্বিগ্ন।
হেরাত প্রদেশে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আফগানিস্তানে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প, যেটিতে তারা ৩০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছে। নতুন করে তৈরির পর সালমা ড্যাম নামে পরিচিত ওই বাঁধের নামকরণ করা হয় ভারত-আফগানিস্তান মৈত্রী ড্যাম, যেটির উদ্বোধন করতে ২০১৬ সালের জুনে আফগানিস্তান গিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আফগান-ভারত সম্পর্কের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত ওই বাঁধে হামলার ঘটনায় তালিবানের উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের মধ্যে শঙ্কা-সন্দেহ হয়তো বাড়িয়ে দিয়েছে।
কয়েক ডজন কূটনীতিককে দিল্লিতে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তের কয়েকদিন আগেই গত সপ্তাহে আফগানিস্তানে ভারতের সাহায্যে নতুন করে তৈরি একটি ড্যাম বা বাঁধে তালিবানের হামলায় কমপক্ষে ১০ জন নিরাপত্তা রক্ষী মারা যায়।
কেন আফগানিস্তানে তালিবান শাসন নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ভারত?
২০০১ সালে আমেরিকার সামরিক অভিযানে ক্ষমতা থেকে তালিবানকে উৎখাত করার পর যে দেশটি আফগানিস্তানে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে সবচেয়ে তৎপর হয়েছিল, সেটি ভারত।
আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে গত দুই দশকে চারশোরও বেশি সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং বড় বড় কিছু অবকাঠামো প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলারেও বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ডজন ডজন প্রকল্প ছাড়াও, দিলারাম-জারাঞ্জ মহাসড়ক নামে ২১৮ কিমি দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক তৈরি করে দিয়েছে ভারত। কাবুলে নতুন আফগান পার্লামেন্ট ভবনটিও ভারতের তৈরী।
চলমান শত শত প্রকল্পের এখন কী হবে? যে উদ্দেশ্যে এসব বিনিয়োগ, তার ভবিষ্যৎ কী? এগুলো কি পানিতে যাবে? ভারতের নীতি-নির্ধারকরা সে চিন্তায় এখন অস্থির।
আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের সাথে সাথেই দ্রুত গতিতে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নিচ্ছে তালিবান। দেশটির কমপক্ষে ৭০ শতাংশ এখন তাদের দখলে বলে দাবি করছে তালিবান, যা খুব শক্ত গলায় প্রত্যাখ্যান করতে পারছে না আফগান সরকার।
এদিকে তালিবান আবারও আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করবে এই সম্ভাবনায় অন্য অনেক দেশ উদ্বিগ্ন হলেও সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পড়েছে ভারত।
দিল্লির জওহারলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. সঞ্জয় ভরদোয়াজ গনমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘অনেক দেশই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, কিন্তু অন্য যে কোনও দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি স্বার্থ এখন ভারতের। তালিবান আবার ক্ষমতা নিলে ভারতের ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি। ভারতের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য আফগানিস্তানের গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে ভারত এখন জটিল এক সংকটে পড়েছে।’
আফগানিস্তানকে কতটা প্রয়োজন ভারতের?
শুধু ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের বিষয়টির জন্যই নয়, বরং ড. ভরদোয়াজের মতে আরও অনেক কারণে ভারতের জন্য আফগানিস্তানের গুরুত্ব রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অভিলাষ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য ভারতের জন্য আফগানিস্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ’
মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢুকতে হলে ভারতের জন্য আফগানিস্তান খুবই জরুরী। আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ইরান ও মধ্য এশিয়ার সাথে দুটো পাইপলাইন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। তবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এসবের চেয়েও বেশি।
ড. ভরদোয়াজ বলেন, ‘কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাথে এবং লাদাখ নিয়ে চীনের সাথে বিপজ্জনক দ্বন্দ্ব রয়েছে ভারতের। এখন আফগানিস্তান শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হলে ভারতের জন্য তা বড়রকম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ভারতের সবচেয়ে বড় চিন্তা আসলে পাকিস্তান। কারণ পাকিস্তান যদি আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা নীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, তা হবে ভারতের জন্য দুঃস্বপ্ন।’
ভারত অনুধাবন করছে তালিবানকে অবজ্ঞা বা অস্বীকার করা সম্ভব নয় এই মুহূর্তে এসে। তবে তালিবানের যা ইতিহাস-আদর্শ, তাতে তাদের সাথে কথা বলা হবে ভারতের জন্য বড় ধরণের বিড়ম্বনা; এমন মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই উভয় সঙ্কটে পড়তে বসেছে দক্ষিণ এশিয়ার এই ‘বিগ বয়’।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ