সমকামীবিদ্বেষ তীব্র হচ্ছে য়ুরোপের বিভিন্ন দেশে। সম্প্রতি সমকামীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে জর্জিয়া, স্পেন, ক্রোয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে। এমনকি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার দাবিতে এলজিবিটিকিউ (লেসবিয়ান, গে, বাইসেকচুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার, কুইয়ার) সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ প্রাইড মার্চেও হামলা হয়েছে। হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে জর্জিয়ান প্রশাসন। এতে এক সাংবাদিকের মৃত্যুকে ঘিরে সরকারের উপর বাড়ছে রাজনৈতিক চাপ। পাশাপাশি আধুনিকতার মুখোশ খুলে যাচ্ছে য়ুরোপের।
জর্জিয়ায় সমকামী বিরোধী সহিংসতা
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে জানানো হয়, মিছিলের আগেই সোমবার জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিতে সমকামী অধিকারবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। এর জেরে পূর্বনির্ধারিত প্রাইড মার্চ বাতিল করেন এলজিবিটিকিউ অধিকারকর্মীরা।
এমনকি এ দিন সমকামীবিদ্বেষীদের ক্ষোভ ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৫০ সংবাদকর্মী। ক্যামেরা-মাইক্রোফোন ও অন্য সরঞ্জাম ভাঙচুর করা হয়; আহত হন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও তাদের সহকারীরা।
সহিংস আক্রমণের নিন্দা জানিয়ে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক ও য়ুরোপীয় সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ জার্নালিস্টস (আইএফজে) ও য়ুরোপিয়ান ফেডারেশন অফ জার্নালিস্টস (ইএফজে) এ ঘটনায় দোষীদের দ্রুততম সময়ে শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে জর্জিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে।
এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিবৃতিতে ‘তিবিলিসি প্রাইড’ জানায়, ‘প্রশাসন এলজিবিটি সম্প্রদায় আর আমাদের সমর্থকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি। সহিংস মানুষে ভর্তি রাস্তায় যেতে পারি না আমরা। কারণ প্রশাসন আর পুরুষতন্ত্রের ঝাণ্ডাধারীরা তাদের মদদ দেয়, সাধারণ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে। সুশীল সমাজ আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তারা।’
য়ুরোপেও ছড়িয়ে পড়ছে সমকামীবিদ্বেষ
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, স্পেনের বড় বড় শহরে একই দিন বিক্ষোভ করে হাজারো মানুষ। ২৪ বছর বয়সী এক স্বাস্থ্যকর্মীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় রাজধানী মাদ্রিদ আর বার্সেলোনাসহ বিভিন্ন শহরে হয় এ বিক্ষোভ। শনিবারের ওই হত্যাকাণ্ড সমকামীদের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্পেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশটিতে জেন্ডার পরিচয় সংক্রান্ত ২৭৮টি বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধ ঘটেছে, যা আগের বছরের তুলনায় আট দশমিক ছয় শতাংশ বেশি।
য়ুরোপিয়ান ইউনিয়ন এজেন্সি ফর ফান্ডামেন্টাল রাইটস জানিয়েছে, বিদ্বেষপ্রসূত হামলার ঘটনার প্রকৃত যে সংখ্যা, তার বেশিরভাগই পুলিশ জানতেই পারে না।
ভাইস নিউজের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আক্রমণে জর্জরিত হয়েছে ক্রোয়েশিয়ায় প্রাইড মার্চও, গত ১০ বছরে যা নজিরবিহীন। শনিবারের ওই মিছিলে কয়েক হাজার মানুষের সঙ্গে ২০ বছরে প্রথমবার যোগ দিয়েছিলেন জাগ্রেব শহরের মেয়র।
জাগ্রেব প্রাইডের আয়োজকদের পক্ষ থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘২০১১ সালের পর এ দেশে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। সমকামীবিদ্বেষী ফ্যাসিবাদীরা চড়াও হয়ে একের পর এক হামলা চালিয়েছে শহরের বিভিন্ন জায়গায়। (তারা) ভাঙচুর করেছে, আগুন লাগিয়েছে।’
সমকামীদের প্রতি রক্ষণশীল ক্রোয়েশিয়া খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ। ২০১৯ সালের এক জরিপে জানা যায়, দেশটির ৬০ শতাংশ সমকামীই জেন্ডার পরিচয়ের কারণে শারীরিক বা মৌখিক আক্রমণের শিকার।
লাশকারাভার মৃত্যু এবং বিপাকে প্রধানমন্ত্রী
এই সহিংসতায় ক্যামেরাম্যান আলেক্সান্ডার লাশকারাভার মৃত্যুর পর বিরোধী দলের আইনপ্রণেতারা জর্জিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জানান৷
এ প্রসঙ্গে আলেক্সান্ডার লাশকারাভার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, জর্জিয়ায় এলজিবিটিকিউ অধিকারকর্মীদের প্রাইড প্যারেড এবং এ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিকদের নিরপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷
ফলে যখন সমকামীবিরোধী ডানপন্থি অ্যাক্টিভিস্টরা প্যারেডে হামলা চালায়, তাদের রক্ষা করার জন্যও কেউ এগিয়ে আসেনি৷ হামলার শিকার হন টিভি পিরভেলির ক্যামেরাম্যান আলেক্সান্ডার লাশকারাভা৷ কদিন পর নিজের বাসায় তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়৷
টিভি পিরভেলির নির্বাহী নানা আবুরজানিদজে জানিয়েছেন, ‘সরকার কেবল দায় অস্বীকারই করছে না, তারা এই সহিংসতাকে ন্যায্যতা দেয়ার চেষ্টা করছে৷ তারা জানতো যে সেখানে ভয়াবহ সহিংসতা হতে পারে, তারপরেও এলজিবিটিকিউ দপ্তর রক্ষায় কোনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল না৷’
লাশকারাভাকে যেদিন পেটানো হয়, সেদিন পঞ্চাশ জনেরও বেশি সাংবাদিক সমকামীবিরোধীদের হামলায় আহত হন৷ সহিংসতার কারণে শেষ পর্যন্ত প্রাইড প্যারেড বাতিল করতে হয়৷
আবুরজানিদজে জানিয়েছেন, লাশকারাভা এবং আরেকজন সাংবাদিক একটি ভবনের ওপরের তলায় আয়োজনের নানা দিক ভিডিও করছিলেন৷ এমন সময় হঠাৎ কিছু মানুষ জোর করে ভেতরে ঢুকে পড়ে৷
তিনি বলেন, ‘তারা সাংবাদিকদের আক্রমণ করা শুরু করে৷ তখন লাশকারাভা এর প্রতিবাদ জানান৷ এরপরই ৩০ জনের মতো মানুষ তাকে পেটাতে শুরু করে, এবং এ কারণেই তার মৃত্যু হয়৷’
জর্জিয়ার রাজধানী ডিবিলিসিতে দ্বিতীয় দিনের মতো কয়েক হাজার মানুষ মিছিল করেছেন৷ তারা সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের বিচার এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন৷
পার্লামেন্টের অধিবেশন চলাকালে সেখানে বিরোধী দলের আইনপ্রণেতাদের বিক্ষোভের মুখে কিছুক্ষণের জন্য অধিবেশন স্থগিত করতে হয়৷ তাদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন জর্জিয়ান ড্রিম পার্টিই সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের জন্য দায়ী৷
জর্জিয়া পুলিশ জানিয়েছে, গণমাধ্যম এবং সংবাদকর্মীদের ওপর সহিংসতার অভিযোগে ২০ জনকে আটক করা হয়েছে৷
সমকামিতা নিয়ে জার্মানির দ্বৈত অবস্থান
জার্মান রাজনীতিতে সমকামিতার প্রভাবে, দেশটির জনগণের মধ্যেও ধীরে ধীরে সমকামীভীতি দূর হচ্ছে৷ কিন্তু এখনেও অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের স্বীকার হন তারা৷
সম্প্রতি জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চ এবং বিলেফেল্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিজেদের এলজিবিটিকিউ ঘোষণা দেয়া ৩০ শতাংশ কর্মীই কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন৷ জরিপে অংশ নেয়া এক তৃতীয়াংশই জানিয়েছেন, তারা সহকর্মীদের এ বিষয়ে জানাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না৷
তবে জার্মানিতে ১৯৬৯ সালে সমকামীদের শাস্তি দেয়ার বিধান বাতিল হলেও ২০১৭ সালে এসে তারা বিয়ের অধিকার পান৷ সে সময় জার্মান পার্লামেন্টে ভোটের মাধ্যমে সমকামীদের বিয়ের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ান রাজনীতিবিদরা৷ কিন্তু ক্ষমতায় থাকা দল সিডিইউ’র ৩০৯ সদস্যের মধ্যে ২২৫ জনই এর বিরুদ্ধে ভোট দেন৷ খোদ চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ছিলেন বিরোধিতাকারীদের একজন৷ তবে পরবর্তী ভোটে রাজনীতিবিদরা যাতে দলের মতাদর্শ মেনে ভোট না দিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে ভোট দেন, সে আহ্বান জানিয়েছিলেন ম্যার্কেল৷
সমকামীদের অধিকারের আন্দোলন যত জনপ্রিয় হতে থাকে, জার্মান রাজনীতিতেও পড়ে এর প্রভাব৷ অনেক রাজনীতিবিদ নিজেদের সমকামিতার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে থাকেন৷ ২০০১ সালের সিটি নির্বাচনে বার্লিনের এসপিডির মেয়র প্রার্থী ক্লাউস ভোভেরাইট দলের সম্মেলনে তার বক্তব্য শেষ করেন এই বলে, ‘আমি সমকামী এবং এটা খারাপ কিছু নয়৷’ পরবর্তীতে ভোভেরাইট মেয়র নির্বাচিত হন এবং টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেন৷
চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টারভেলে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক সফরে তার পার্টনার মিখায়েল ম্রোনৎসকে নিয়ে যেতেন৷ এখন এমনকি সমকামিতার বিরুদ্ধে কথা বলে এমন কট্টর ডানপন্থি দল এএফডির এক নেত্রী অ্যালিস ভাইডেলও এক নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন৷
জার্মানির বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েনস স্পান নিজেকে সমকামী ঘোষণা দেয়া প্রথম মন্ত্রী ৷ দলের অন্যতম উদীয়মান রাজনীতিবিদ বলে বিবেচনা করা হয় স্পানকে৷ করোনা মহামারিতে নিজের দেশকে দারুণভাবে সামাল দেয়ায় দল ও দেশ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি৷
ম্যার্কেলের পর সিডিইউয়ের প্রধান হওয়ার লড়াইয়েও অনেক এগিয়ে আছেন স্পান৷ জিতে গেলে তিনি হতে পারেন প্রথম সমকামী জার্মান চ্যান্সেলর৷
হাঙ্গেরিতে সমকামীবিরোধী আইন পাস
গত বুধবার বিতর্কিত একটি সমকামীবিরোধী আইন পাস করেছে হাঙ্গেরি। ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনটির ফলে হাঙ্গেরির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সমকামীদের প্রতি সহাবস্থানমূলক ও জেন্ডার পরিবর্তন সমর্থনযোগ্য পাঠদান ও প্রচার নিষিদ্ধ হচ্ছে।
এখন থেকে দেশটিতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য যৌন শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে থাকবে না সমকামী বা জেন্ডার পরিবর্তনবিষয়ক কোনো বিষয়বস্তু।
তবে সংবিধানে সমকামীবিরোধিতা ও বৈষম্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে আইনটির নিন্দা জানিয়েছেন য়ুরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন দার লিয়েন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ