দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। যাকে বলা হচ্ছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই সংক্রমণে বয়স্কদের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত তরুণেরাও আক্রান্ত হচ্ছেন, এমনকি শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না। এ বছর ভাইরাসের নতুন ধরন আসায় অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি শিশুমৃত্যুর ঘটনাও কম ঘটছে না।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় গত ১০ দিনে জেলার ৪ বছর বয়সী এক শিশুসহ ৫৭ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। জেলায় এবারই প্রথম ৪ বছর বয়সের কোনো শিশু করোনা আক্রান্ত হয়েছে।
এর আগে, পশ্চিমের সীমান্ত জেলা নওগাঁর সাপাহারে আট মাস বয়সী এক শিশু করোনা সংক্রমণে মারা যায়। সাপাহার উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রুহুল আমিন জানিয়েছেন, গত ৩১ মে সকাল ৭টার দিকে সাপাহার থানার এক নারী পুলিশ সদস্য তার ৮ মাস বয়সী ডায়রিয়া আক্রান্ত ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করান। দু’দিন পরে ২ জুন শিশুটি মারা যায়। শিশুটির আকস্মিক মৃত্যুর কারণ নিয়ে সংশয় দেখা দিলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার নমুনা পরীক্ষার জন্য পিসিআর ল্যাবে পাঠায়। বুধবার শিশুটির করোনা পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া গেছে।
এদিকে রাজশাহীর ল্যাব থেকে পাঠানো রিপোর্টে এবার ২ বছরের শিশুর শরীরে করোনা সংক্রমণের রিপোর্ট এসেছে।
শিশুদের করোনার লক্ষণ
- আক্রান্ত শিশুদের অনেকেরই (প্রায় ৮০ শতাংশ) তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। রোগের তীব্রতাও বেশি থাকে না। তারা সাধারণত জ্বর, কখনো কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, নাক দিয়ে পানি পড়া, নাক বন্ধ, ক্ষুধামান্দ্য, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি নিয়েই চিকিৎসকের কাছে আসে। এ ছাড়া আক্রান্ত শিশুদের অনেকেরই ক্লান্তি, দুর্বলতা, শরীরে ব্যথা, বমি বমি ভাব, খাবারে স্বাদ বা গন্ধ না পাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ থাকে। তবে আশার কথা, বেশির ভাগ আক্রান্ত শিশু এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
- কিন্তু যেসব শিশু আগে থেকেই নানা রকম অসুস্থতায় ভুগছে, যেমন মোটা বা স্থূলকায়, যাদের ডায়াবেটিস, হাঁপানি, হৃৎপিণ্ডের জন্মগত ত্রুটি, শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় ঘাটতিসহ অন্যান্য সমস্যা যাদের আছে, তাদের করোনা হলে তা মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
- এ ছাড়া কোভিডে আক্রান্ত শিশুরা অনেক সময় এমআইএস-সি নামের মারাত্মক এক জটিলতায় পড়ে যায়, যা জীবন সংশয় সৃষ্টি করতে পারে। এই সমস্যায় কোভিডে আক্রান্ত শিশুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত হয়। জ্বর সময়ের সঙ্গে কমে না বরং তা আরও বেড়ে যায়। সঙ্গে শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ আসে, চোখ, ঠোঁট, জিহ্বা, হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে লাল হয়ে যায়, কখনো কখনো হাত বা পায়ের পাতা ফুলে যায়, পাতলা পায়খানার সঙ্গে অনেকের পেটে ব্যথা হয় এবং শিশু অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেক সময় রক্তচাপ কমে যায়, শ্বাসকষ্ট হয়, মাড়ি, নাক দিয়ে রক্তপাত হয়।
প্রতিরোধ
- করোনা প্রতিরোধের মূলমন্ত্র স্বাস্থ্যবিধি মানা। মাস্ক পরতে হবে, পরস্পরের দূরত্ব কমপক্ষে দুই হাত বজায় রাখতে হবে, নিয়মিতভাবে সাবানপানিতে হাত ধুতে হবে এবং কনুইয়ের ভাঁজে হাঁচি-কাশি দিতে হবে।
- বড়দের এগুলো গুরুত্বের সঙ্গে চর্চা করতে হবে, তাহলে শিশুরাও শিখবে। এ সময়ে ঘরবন্দী শিশুদেরও শেখাতে হবে কীভাবে হাত ধুতে হয়, মাস্ক পরতে হয় ইত্যাদি। মা-বাবা করোনা প্রতিরোধে এগুলোর গুরুত্ব নিয়মিতভাবে শিশুদের সঙ্গে আলোচনা করবেন এবং যারা নিয়মিতভাবে এগুলো করবে, তাদের পুরস্কার দিন।
- এ সময় ঘরের ভেতরে শিশুদের অবস্থান আনন্দময় করার জন্য বাড়ির বড়রা ছবি আঁকা, হালকা ব্যায়াম, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন আয়োজন করবেন, যাতে শিশুরা লকডাউনে বন্দিজীবনে বিরক্ত না হয়ে যায়।
- জ্বরে আক্রান্ত বা অসুস্থ যেকোনো মানুষ থেকে শিশুদের দূরে রাখা জরুরি। শিশুর উপসর্গ না থাকলেও সে পরিবারে একজন গুরুত্বপূর্ণ বাহকে পরিণত হতে পারে। বয়স্কদের কাছ থেকে এ সময় তাকে দূরে রাখুন।
- বিপণিবিতান বা কোনো জনসমাগমের স্থানে শিশুদের কোনোভাবেই নিয়ে যাওয়া যাবে না। এ সময় বাইরের অতিথি না এলেই ভালো।
- বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ বাইরে গেলে বাসায় ঢোকার আগে সাবানপানিতে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেবেন, পা ধুয়ে ঘরে ঢুকবেন এবং তারপর সরাসরি গোসল করে শিশুর সংস্পর্শে আসবেন।
- ঘরের যেসব জায়গায় আমাদের বারবার ব্যবহার বা স্পর্শ করা লাগে, সেগুলো দৈনিক পরিষ্কার করতে হবে।
- জরুরি স্বাস্থ্যসেবা যেমন টিকা দেওয়া বা অন্য কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে শিশুকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়ার দরকার হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, ভিড় এড়িয়েই তা করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে আবারো উদ্বেগ
করোনাভাইরাস মহামারিতে এখন বাংলাদেশে একদিকে টিকার সংকট আর অন্যদিকে ডেল্টা বা ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়ান্ট ছড়িয়ে পড়ায় জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে আবারো উদ্বেগ বাড়ছে। গত কয়েকদিন ধরে মৃত্যু ও সংক্রমণ উর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন কোন ধরনের করোনাভাইরাস বেশি ছড়াচ্ছে- সেটি খুজে দেখতে সংক্রমিত বিভিন্ন এলাকার ৫০টি নমুনার জিনম সিকোয়েন্সিং করে চারটি ধরন পাওয়া গেছে। চারটি ধরনের মধ্যে ৮০ শতাংশই ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়ান্ট।
ঢাকার বাইরে সীমান্তবর্তীসহ অর্ধেকের বেশি জেলা শহরে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণের উর্ধ্বগতির এ বাস্তবতায় প্রায় দেড় মাস ধরে টিকা কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর দিকে আরো আগে থেকেই নজর রাখা উচিত ছিল। বিশেষ করে যখন পাশের দেশে ব্যাপকভাবে সংক্রমণ বেড়ে যায় তখনই যদি দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্যাপকভাবে টিকা দেওয়া যেত, তবে হয়তো এখন ওই সব এলাকায় এত সংক্রমণ না-ও হতে পারত। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ এখন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে জরুরি টিকাদান কার্যক্রম চালানো দরকার বলে মত দিলেও এ ব্যাপারে ভিন্নমতও আছে বলে খবরে প্রকাশ।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, এখন যেসব এলাকায় সংক্রমণ তুলনামূলক কম আছে, সেই এলাকাগুলোতে টিকা দেওয়া গেলে বেশি উপকার হবে, সেখানে সংক্রমণ ছড়াতে পারবে না।
সীমান্তবর্তী এলাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, যেসব সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নেই সেসব স্থান দিয়ে অবাধে চলাচল। এই চলাচল সীমান্ত এলাকায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ালেও বিষয়টি নিয়ে এলাকার মানুষ খুব একটা সচেতন বলে মনে হয় না।
এসডব্লিউ/এমএন/এফএ//১৫৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ