এডিস ইজিপ্টি নামে এক ধরনের মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ হয়৷ এই মশা দমন করার জন্য গবেষকরা বেশ কিছুদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এখন তারা এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দিয়ে মশাকে সংক্রামিত করে ডেঙ্গুর ভাইরাসকে কাবু করতে চান৷ প্রাণঘাতী ডেঙ্গু দমনে সহজ একটি কৌশল ব্যবহার করেই অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা জানিয়েছেন, এই ‘বিস্ময়কর’ কৌশল ব্যবহার করে ডেঙ্গুর প্রকোপ ৭৭ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, বিজ্ঞানীরা মশার শরীরে এমন একটি ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করান, যেটি তাদের ডেঙ্গু বিস্তারের ক্ষমতা বহুলাংশে কমিয়ে দেয়।
সম্প্রতি এই ট্রায়াল পরিচালিত হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার ইয়োগিয়াকার্তা শহরে। ট্রায়ালের অবিশ্বাস্য ফলাফলে খুব সহজেই ডেঙ্গুজ্বর নির্মূলের আশা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
পরীক্ষামূলক গবেষণায় ‘উলবাকিয়া’ নামের ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত মশা ব্যবহার করা হয়েছে। কেটি আন্দ্রেজ নামের এক গবেষক এই ব্যাকটেরিয়াকে ‘অলৌকিক’ ব্যাকটেরিয়া হিসেবে অভিহিত করেছেন। উলবাকিয়া নামের এই ব্যাকটেরিয়া মশাদের কোনো ক্ষতি করে না। তবে এই ব্যাকটেরিয়া মশার শরীরের যে অংশ দিয়ে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করে, সেটি নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
এই ব্যাকটেরিয়া ডেঙ্গু ভাইরাসের পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া কঠিন করে তুলতে পারে। এ কারণে কামড়ানোর পর মশা থেকে সংক্রমণের মাত্রা কমে যায়।
ইন্দোনেশিয়ার ট্রায়ালে উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত ৫০ লাখ মশার ডিম ব্যবহার করা হয়েছে। ডিমগুলো পানিভর্তি বালতিতে করে প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর ইয়োগিয়াকার্তা শহরে রেখে আসা হয়। শহরটিকে ২৪টি অঞ্চলে ভাগ করে এর অর্ধেকজুড়ে মশা ছাড়া হয়। এভাবে সেখানে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত মশার বড় একটি জনগোষ্ঠী তৈরি হতে প্রায় ৯ মাস সময় লাগে।
গবেষণায় দেখা গেছে, উলবাকিয়া নামের এই ব্যাকটেরিয়া এক মশার ডিম থেকে জন্ম নেওয়া অন্য মশাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। মশা নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদ্ধতি যেমন কীটনাশক বা পুরুষ মশার বন্ধ্যকরনের চেয়ে এ কৌশল অনেক সহজ ও কার্যকর।
পরীক্ষামূলক গবেষণার ফলাফল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত হয়েছে। ফলাফলও আশাব্যঞ্জক। দেখা গেছে, এতে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার ৭৭ শতাংশ কমেছে। আর ৮৬ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
ওয়ার্ল্ড মসকুইটো প্রোগ্রামের প্রভাব মূল্যায়ন বিভাগের পরিচালক ডা. কেটি আন্দ্রেজ বিবিসিকে বলেছেন, ‘এটি খুব চমকপ্রদ। আমরা যা আশা করেছিলাম, ফলাফল তার চেয়েও ভালো।’
এই কৌশল এতটাই সফল হয়েছে যে পুরো শহরে মশাগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়। শুধু ইয়োগিয়াকার্তাই নয়, এর আশপাশের এলাকাগুলোতেও এ ধরনের ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত মশা ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই অঞ্চল থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ নির্মূল করতেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ডা. আন্দ্রেজ বলেন, এ ফলাফল যুগান্তকারী। আমরা মনে করি, বিশ্বের যেসব বড় শহরে ডেঙ্গু বিশাল জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এটি আরও বেশি প্রভাব ফেলতে পারে।
ইয়োগিয়াকার্তা শহরে রোগ প্রতিরোধবিষয়ক প্রধান ইউদিরিয়া আমেলিয়া বলেন, ‘পরীক্ষামূলক গবেষণার ফলাফলে আমরা আনন্দিত। আমরা আশা করছি, এই পদ্ধতি ইয়োগিয়াকার্তার সব এলাকায় বাস্তবায়ন করা হবে। এরপর দেশটির অন্যান্য শহরে এই পদ্ধতি ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডেঙ্গুবাহী মশা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে চলা গবেষণার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক। ডিজিজ মডেলিং স্টাডিজেও দেখা গেছে, উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করতে পারে।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডেভিড হামার বলেছেন, জিকা, ইয়েলো ফিভার ও চিকুনগুনিয়ার মতো রোগের ক্ষেত্রে এ গবেষণাপদ্ধতি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর মতো এই রোগগুলোও মশার কামড় থেকে ছড়ায়।
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে৷ এদের অধিকাংশই শিশু-কিশোর৷ তবে এবার বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর ডেঙ্গু ভাইরাসকে খতম করতে সক্ষম অ্যান্টিবডি’র খোঁজ পেলেন৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় যার মধ্যে ক্লিনিকে নেওয়ার অবস্থা হয় প্রায় ৯৬ মিলিয়ন আক্রান্তের।
আইসিসিডিআরবি, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের একটি সমন্বিত গবেষণা বলছে, প্রতিবছর প্রায় ২৪ লক্ষ লোক বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই জ্বর থেকে অধিকতর মারাত্মক হেমোরেজিক জ্বর ও শক সিনড্রোমের প্রাদুর্ভাবের বৃদ্ধির কারণে এটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ