রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা সার্বিয়ার পার্মাফ্রস্ট (ভূগর্ভস্থ হিমায়িত অঞ্চল) খনন করে হিমায়িত মাটির কোর থেকে এক প্রাণীর সন্ধান পান, যে জমাট বাঁধা বরফে টানা ২৪ হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকার পর আবার জেগে উঠেছে। এর নাম ডেলোইড রোটিফার্স।
কারেন্ট বায়োলজি নামের একটি জার্নালে গত সোমবার প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কয়েক হাজার বছর ধরে হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় থাকার পরেও ডেলোইড রোটিফার্স আবার জীবিত হয়ে ওঠে।
সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
এরা হচ্ছে গুটি কয়েক টেনসি গোত্রের প্রাণী যা অবিশ্বাস্যরকমভাবে পুরোপুরি অপ্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য সুপরিচিত।
অতিক্ষুদ্রাকার ও বহুকোষী প্রাণী ডেলোইড রোটিফার্স দেহে জটিল শারীরিক গঠন থাকায় এরা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিকিরণ সহনীয় অণুজীব।
এরা তীব্র মাত্রার অম্লতা, অনাহার, কম মাত্রার অক্সিজেন এবং অনেক বছর ধরে চলা পানি শূন্যতা সহ্য করে টিকে থাকতে পারে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞানী ম্যাথিউ ম্যাসেলসন বলেন, ‘এরা বিশ্বে যেকোনো ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যেও বেঁচে থাকতে পারে। সহনশীলতার বিবেচনায় এরা বিশ্বের সব প্রাণীকে ছাড়িয়ে গেছে।’
গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়ায় পারমাফ্রস্টের (মাটির নিচে বরফের স্তর) মধ্যে প্রায় ১১ ফুট খনন করে এই জাতীয় শক্তিশালী অণুজীবগুলোর নমুনা সংগ্রহ করেন।
প্রাচীন এসব পারমাফ্রস্টের মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় ১৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় নিচে হাজার হাজার বছর ধরে টিকে রয়েছে এ ধরনের অণুজীব।
রাশিয়ার সয়েল ক্রায়োলজি ল্যাবরেটরির গবেষক স্টাস মালাভিন বলেন, আজকের হিসাবে প্রমাণিত হয় যে বহুকোষীয় প্রাণী কয়েক হাজার বছর ক্রিপ্টোবায়োসিস সহ্য করতে পারে। ক্রিপ্টোবায়োসিস হচ্ছে প্রায় পুরোপুরি মেটাবলিজম (বিপাক) বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশা।
এই গবেষকদের আগের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, রোটিফার্স হিমায়িত অবস্থায় ১০ বছরের বেশি সময় টিকে থাকতে পারে। নতুন গবেষণায় রাশিয়ার গবেষকেরা রেডিওকার্বন ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখেছেন, পার্মাফ্রস্ট থেকে বের করে আনা আণুবীক্ষণিক প্রাণীগুলো ২৪ হাজার বছরের পুরোনো।
গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ওডস হোলে অবস্থিত মেরিন বায়োলজিকাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী ক্রিস্টিন গ্রিবল বলেন, ‘তীব্র ক্ষমতাসম্পন্ন এই সব অণুজীব চরম প্রতিকূল পরিবেশ সহ্য করে বেঁচে থাকার এটি আরও একটি উদাহরণ।’
বয়স নির্ধারণে ব্যবহৃত রেডিওকার্বন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায় এই ধরনের অণুজীবগুলো ২৪ হাজার বছর আগের। সব বাধা পেরিয়ে তারা এখনও জীবিত এবং বংশবিস্তারে সক্ষম।
আমাদের চারপাশে শ্যাওলাযুক্ত আর্দ্র স্তূপ, বৃষ্টির পানি, পাখির স্নানের পানি এবং আর্কটিক ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল এবং এর মধ্যবর্তী সব মিঠা পানিতেই রয়েছে ডেলোইড রোটিফার্স।
মাইক্রোস্কোপের আবিষ্কারের পর থেকেই এদের নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
অবশ্য পুরোপুরি হিমায়িত আবাসস্থল থেকে কোনো প্রাচীন প্রাণীর সন্ধান পাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে হাজার বছরের পুরোনো নমুনা থেকে অ্যান্টার্কটিক মস সফলভাবে জন্মানো গেছে। এ ছাড়া সার্বিয়া থেকে ৩০ হাজার বছরের পুরোনো নেমাটোড পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
১৭০২ সালে, অ্যান্টনি ভ্যান লিউয়েনহোয়েক তার বাড়ির ড্রেনের পানিতে ডেলোইড রোটিফার্স শনাক্ত করেন যাদের তিনি নাম দেন ‘ক্ষুদ্র গোলাকার অণুজীব।’
কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনও ঠিক বুঝতে পারছেন না যে কীভাবে ডেলোইড রোটিফার্স তাদের কোষ এবং অঙ্গগুলো ভয়াবহ বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে সুরক্ষিত রাখতে পারে এবং ভেঙে যাওয়া ডিএনএগুলো আবারও সারিয়ে তুলতে পারে।
নিজেদের টিকিয়ে রাখতে এই অণুজীবগুলোর জৈবিক কৌশলগুলোর ওপর আরও বেশি গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তাদের কোষ, টিস্যু ও অঙ্গ সুরক্ষার এই রহস্য উম্মোচিত হলে তবে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীদের কোষ ও টিস্যু হাজার বছর টিকিয়ে রাখার যাবে বলে আশা ব্যক্ত করেন বিজ্ঞানীরা।
মালাভিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, গবেষণায় দেখা গেছে, বহুকোষী জীব হিমায়িত করে শত শত বছর সংরক্ষণ করা যায় এবং তা জীবিত ফিরিয়ে আনা যায়। অনেক কল্পলেখকের কল্পনায় ছিল বিষয়টি। তবে জীব যত জটিল হবে, তা জীবন্ত সংরক্ষণ আরও কঠিন হবে। স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে তা বর্তমানে সম্ভব নয়। তবে এককোষী প্রাণী থেকে যেসব আণুবীক্ষণিক প্রাণীর অন্ত্র ও মস্তিষ্ক আছে, তা সংরক্ষণের দিক থেকে একটি বড় ধাপ অর্জিত হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১২
আপনার মতামত জানানঃ