করোনার সম্ভাব্য হটস্পট হতে পারে কোন কোন দেশ, তার উপর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মিলান পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি এবং ম্যাসে ইউনিভার্সিটি অব নিউজিল্যান্ডের একদল গবেষকের তৈরিকৃত প্রতিবেদনে নাম আছে বাংলাদেশের। ঢিলেঢালা লকডাউন, টিকা প্রদানে ধীরগতি আর অব্যবস্থাপনার সুযোগে তৈরি হওয়া অসচেতনতাই কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের জন্য।
এদিকে ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের পরিস্থিতি ভাইরাসের সম্ভাব্য বাহক ও মানুষের সংস্পর্শে আসার মধ্য দিয়ে নতুন দুর্যোগের সৃষ্টি করতে পারে। সংক্রমণ ছড়ানোর মতো এমন ভাইরাল হটবেড সম্পর্কে জানা থাকলে ভবিষ্যতে কোভিড-১৯-এর মতো মহামারি এড়ানো যাবে।
যেহেতু সার্স-কভ-২ করোনা ভাইরাস চীনের উহানে বাদুড় থেকে মানব দেহে সংক্রমিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এর উৎস সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি। তাই এবার সম্ভাব্য হটস্পট খুঁজে বের করার লক্ষ্যে পরিচালিত গবেষণায় কয়েকটি হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে যেসব স্থানে নতুন করোনা ভাইরাস মাথাচাড়া দিতে পারে। আর এ তালিকায় আছে বাংলাদেশের নামও।
যেভাবে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশ
বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক দল ভূমি ব্যবহারের প্রবণতা ও এশীয় বাদুড়ের আবাসস্থল পর্যালোচনা করেছেন রিমোট অ্যানালাইসিস টুল কাজে লাগিয়ে। এসব বাদুড় করোনা ভাইরাসের বাহক বলে পরিচিত। তারা চিহ্নিত করেছেন কয়েকটি হটস্পট যেখান থেকে জুনোটিক ভাইরাস বাদুড় থেকে মানব দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
গবেষণা অনুসারে, বর্তমানে বেশিরভাগ হটস্পট চীনে রয়েছে। শুধু চীন নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একাধিক অঞ্চলও হটস্পট হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আরও যেসব উল্লেখযোগ্য হটস্পটের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো ভুটান, পূর্ব নেপাল, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, জাভা, উত্তর-পূর্ব ভারত ও কেরালা রাজ্য।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকায় এর আগে বাদুড় সংশ্লিষ্ট জুনোটিক রোগ নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে।
বিজ্ঞানীরা পর্যালোচনায় জানতে পেরেছেন, ক্রমাগত বনাঞ্চল হ্রাসের কারণে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার হটস্পট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব অঞ্চল জাপান, উত্তর ফিলিপাইন ও চীনে (বিশেষ করে শাংহাইয়ের দক্ষিণাঞ্চলে) অবস্থিত।
এছাড়া গবেষকরা বলেছেন, গবাদি পশুর উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার কারণে থাইল্যান্ডের কিছু অংশও হটস্পটে পরিণত হতে পারে।
গবেষণা দলের সদস্য ড. মারিয়া ক্রিস্টিনা রুল্লি বলেন, আমরা আশা করি এই ফলাফল অঞ্চলভিত্তিক করোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকানোর লক্ষ্যে সতর্কতা বৃদ্ধি করবে।
এছাড়া বাংলাদেশে মহামারির ঢেউয়ে এখনও বড় কোনো ধকল আসেনি। এতে ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মতুষ্টি তৈরি হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার প্রবণতা কম দেখা যাচ্ছে।
ফলে মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাসে করোনার সংক্রমণ বাড়লে সরকার নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করে। করোনায় ৯ এপ্রিল বাংলাদেশে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক ১১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। পরে ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া টিকাদান কর্মসূচি চললেও এগোচ্ছে ধীরগতিতে। এখন পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৮০ লাখ লোক। এর মধ্যে উভয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ২৮ লাখ ১০ হাজার জনকে। এখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো— ভারতীয় সংকট সীমান্ত ছাপিয়ে যাতে এখানে ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যাতে বিপর্যয় নেমে না আসে। তবে ইতিমধ্যেই দেশের সাতটি জেলায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা
অন্যান্য জেলার চেয়ে সীমান্তের ১১টি জেলায় সংক্রমণ শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী। এসব জেলার হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেনসহ অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রী মজুত করা হয়েছে। গতকাল বুধবার অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য বুলেটিনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সীমান্তবর্তী যেসব জেলায় করোনা রোগী বাড়ছে, সেখানকার প্রশাসন স্থানীয়ভাবে লকডাউনসহ কিছু বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করছে। গতকাল নওগাঁ পৌরসভাসহ কয়েকটি উপজেলা এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। খুলনা নগরের তিন থানা এলাকায় দোকানপাট বন্ধসহ বিধিনিষেধ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাজশাহী জেলা প্রশাসন সন্ধ্যা সাতটা থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বের না হওয়াসহ বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করেছে।
করোনা রোগী বাড়তে শুরু করায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরে সীমান্তবর্তী আরও সাতটি জেলা লকডাউন করার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি। জেলাগুলো হচ্ছে নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও খুলনা। এ ছাড়া কক্সবাজার, ফেনী ও সিলেট জেলাতেও সংক্রমণ বাড়ছে।
গতকাল বুলেটিনে অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক (সিডিসি) অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে শনাক্তের হার অন্য যেকোনো জেলার তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। গত ২৬ মে শনাক্তের হার ছিল ৯ দশমিক ১১ শতাংশ।
সে দিন ১ হাজার ৪৯৭ জন রোগী চিহ্নিত হয়। তারপর তিন দিন সংক্রমণের সংখ্যা খানিকটা কম ছিল। এরপর আবার সপ্তাহের শেষে এসে ৩১ মে এবং ১ জুনে শনাক্তের সংখ্যা ১ হাজার ৭০০ ছাড়িয়ে গেছে। এর মানে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ৯০ ভাগই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাকি ১০ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে যেতে হচ্ছে এবং তাদের অনেকেরই অক্সিজেনের প্রয়োজন হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব জেলায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারা দেশে প্রায় ১ হাজার ৫৮৯টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা এবং ১ হাজার ৪৬৯টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর সরবরাহ করা হয়েছে।
সীমান্তবর্তী নওগাঁ জেলায় করোনা সংক্রমণের হার প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। গত ২০ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত করোনা শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে নওগাঁ পৌরসভা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় এক সপ্তাহের জন্য সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার সাপাহার, পোরশা ও মান্দা উপজেলায় বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশীদ গতকাল এ ঘোষণা দেন।
জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশীদ বলেন, গত ঈদুল ফিতরের পর থেকে নওগাঁয় করোনা সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের ওপরে। জেলার মধ্যে নওগাঁ পৌরসভা ও সীমান্তবর্তী উপজেলা নিয়ামতপুরে দুই সপ্তাহ ধরে করোনার সংক্রমণের হার প্রায় ৫০ শতাংশ। পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় গতকাল রাত ১২টা থেকে লকডাউন দেয়া হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নতুন বিধিনিষেধ জারি করেছে রাজশাহী জেলা প্রশাসন। এ সময় রাজশাহীর শপিং মলগুলো বন্ধ থাকবে, সন্ধ্যা সাতটা থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না, রেস্তোরাঁয় বসিয়ে ক্রেতাদের খাওয়ানো যাবে না, কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উন্মুক্ত স্থানে সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে।
খুলনা নগরের সদর, সোনাডাঙ্গা ও খালিশপুর তিন থানা এলাকায় দোকানপাট বন্ধসহ কিছু বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। ৪ জুন থেকে ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। খুলনা জেলা সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ এ প্রসঙ্গে বলেন, লকডাউন হচ্ছে না। তবে তিন থানায় সাত দিন ওষুধ, কাঁচাবাজার ছাড়া সারা দিন দোকানপাট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাত দিন পর যদি পরিস্থিতি সে রকম উন্নতি না হয়, তাহলে কঠোর সিদ্ধান্ত হবে
তবে এখন ভাইরাসের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে মানুষকে বোঝাতে সরকার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এছাড়া ঈদে রাজধানী থেকে ঘরমুখো মানুষের ঢল সংক্রমণের হারকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এই মুহূর্তে জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে টিকার আওতায় আনতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ