মোহাম্মদ রুবেল
পশ্চিম বঙ্গের প্রয়াত মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে একবার সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিল, আপনার রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কেন হয়না? জবাবে তিনি বলেছিলেন, সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয়না। সারকথা হলো, সরকার চাইলে দাঙ্গা হয় আর না চাইলে হয়না। যখন কোন ইস্যুকে সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তখন সেটা ভালো হোক বা মন্দ হোক, জনগণের উপর সেটা প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের সরকারগুলো নিজেদের প্রয়োজনে যেমন খুশি তেমন সাজে নিজেদেরকে সজ্জিত করে। তারই সমান্তরালে জনগণও মুসার সময় মুসা, আর ঈসার সময় ঈসার দৈব বাণীর মতো সরকারের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। এদেশে পাকিস্তান আমলে যুদ্ধের সময়েও পাকিস্তানের স্বপক্ষেও বিশাল বিশাল মিছিল হয়েছে, আবার বাকশালের সময় বাণের জলের মতো মানুষ বাকশালি হয়েছে, জিয়া-এরশাদ সামরিক উর্দি ছেড়ে যখন সাফারি পরল তখনও এদেশের মানুষ তাদেরকে নিরাশ করেনি। মোদ্দাকথা, রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য না থাকলে তত্ত্ব – কাগজে কলমেই রয়ে যায়, নইলে জাসদের লাখ টাকার বাগান দুই টাকার ছাগলে কেমনে খাইলো?
সক্রেটিস নামীয় যে লোকটা তৎকালীন এথেন্সের রাষ্ট্রীয় বুদ্ধিজীবি নামক পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে কথা বলে বিচারের মুখোমুখি হয়েছিল, সরকার চাইলে ন্যায় বিচার করে সক্রেটিসকে মুক্তি দিতে পারতো। কারণ জনমত সক্রেটিসের পক্ষেই ছিল। সরকার চেয়েছিল সক্রেটিসকে থামাতে, তাই সক্রেটিসকে থামতে হয়েছিল। আবার গ্রীসের নগর রাষ্ট্রের কর্তারা বিচারহীন হত্যার সমর্থক ছিলেন না বিধায় সক্রেটিসও পালিয়ে যাননি আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হওয়ার ভয়ে। আমাদেরকে আলো-অন্ধকারের মধ্যে বৈষম্য করলে চলবেনা, কারণ অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না। যিশুর মৃত্যুর তিনশো বছর পরেও পৃথিবীতে খ্রিস্টানিটি হালে পানি পায়নি। ইহুদিদের চরম রোষানলে পড়ে যিশুর বারো শিষ্যের কেউই নির্বিঘ্নে যিশুর বাণী প্রচার করতে পারেনি। চতুর্থ শতকে সম্রাট কনস্টাটাইন যখন দেখলেন তার সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সৈন্যই যিশুর প্রতি গোপনে বিশ্বাস স্থাপন করেছে তারই জের ধরে রাজ্য ধরে রাখার নিমিত্তে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করেন এবং একে রাষ্ট্রধর্মে রুপদান করেন। তখন হতে খ্রিস্টানিটিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন অনেকেই বলেন ইয়োরোপীয়রা নাকি যিশুর অমর বানী “শত্রুকেও ভালোবাস” বিশ্বাস করে খ্রিস্টান হয়েছে। তাদের এই ধারণা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আজকের খ্রিস্টানিটি একথা অস্বীকার করার সাধ্য কার আছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামের প্রচার প্রসার। বিশেষ করে উমাইয়া, আব্বাসীয় ও অটোমানরা তাদের রাজত্বের স্পিরিটের সাথে ইসলামের সমন্বয় ওতপ্রোতভাবেই করেছিল। মুসলিম রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীক ও রোমান জ্ঞান – বিজ্ঞানের অনুবাদ করে মুসলমান মনীষীরা প্রায় পাঁচশো বছর পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো অথচ তখন ইয়োরোপে চলছিল হানাহানি আর অরাজকতা। এখন মুসলমান দেশের সরকারগুলো চায় না মুসলমানরা জ্ঞান – বিজ্ঞান চর্চা করুক তাই মুসলমানদের অবস্থা মধ্য যুগের খ্রিস্টানদের মতো।
খ্রিস্টানিটি ও ইসলাম ধর্মকে মডেল ধরেই আজকের ইসরায়েল রাষ্ট্র। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে ইহুদি একটা ধর্মের নাম হলেও তারা একটা জাতি হয়ে উঠতে পারেনি। ইহুদীরা যখন রাষ্ট্র বানিয়ে ধর্মকে সেবা দিতে শুরু করলো তখনই এই ধর্মের প্রভাব আধুনিক বিশ্ব দেখতে পায়। যদি “পিওর ইহুদি তত্ত্ব” ও কিছু গোঁড়ামি না থাকতো তাহলে সংখ্যায় ইহুদীরা শত কোটি পেরিয়ে যেত; যদিও ইহুদীরা সংখ্যার চাইতে গুনগত মানকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। বর্তমান বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ইহুদিদের একচেটিয়া অবদান থাকলেও, ইসরায়েল রাষ্ট্রটা বহুদেশের স্বীকৃতি আদায়ে সফল হলেও – এখনো বিশ্বে গ্রহনযোগ্য রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি; যদিও তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আর আমাদের প্রতিবেশী ভারতে ঐতিহাসিকভাবে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও হিন্দুত্ববাদ কখনোই অতটা তীব্র হয়নি, বিশেষ করে বিজেপি নামক দলটা ক্ষমতায় যাওয়ার পূর্বে। তারাও এখন তাদের মোদী বাবুর মাঝে এরদোয়ানের প্রতিচ্ছবি দেখতে চান। শুধুমাত্র বৌদ্ধরা মায়ানমারে সামরিক জান্তার বুট এবং চীনের কমিউনিস্টদের বিতাড়িত করতে পারেনি বিধায় এখনো এদেশগুলোতে ভিক্ষু প্রধানমন্ত্রী দেখতে আমাদের বিলম্ব হচ্ছে। রাষ্ট্র চাইলে অক্সফোর্ড – হার্ভাড- নাসা – বাইতুল হিকমাহ হয়, আবার রাস্ট্র চাইলে মসজিদ মন্দির হয়, গির্জা মসজিদ হয়। রাষ্ট্র চাইলে দেশ সুইজারল্যান্ড – জাপান হয়, আবার ইথোপিয়া – মোজাম্বিকও হয়।
মোহাম্মদ রুবেল, ভিয়েনা
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ