দেশে সাইনবোর্ডসর্বস্ব বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসার নামে রোগীদের হয়রানি, মারধর এমনকি হত্যার আরও একটি অভিযোগ সামনে এলো। এবার রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড নামে একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তির পর পুলিশ কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। সোমবার সকালে হাসপাতালটিতে ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যেই লাশ হয়ে যান জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম শিপন। নিহতের পরিবার এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে এটি স্পষ্টভাবেই একটি হত্যাকান্ড। হাসপাতালটির সিসিটিভি ফুটেজে বেশ কয়েকজন লোক মিলে কয়েক মিনিট ধরে পুলিশ কর্মকর্তা শিপনকে বেধড়ক মারধর করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা এবং প্রাথমিক তদন্তের পর ঢাকা মহানগর পুলিশ গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘটনাকে হত্যাকান্ড বলে দাবি করেছে। অন্যদিকে, পুলিশের সংবাদ সম্মেলন থেকে জানা গেছে হাসপাতালটি পরিচালনার বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। মানসিক রোগীর চিকিৎসার নামে হাসপাতালটি চিকিৎসা-বাণিজ্য করে আসছিল। প্রশ্ন হলো কেন কেবলই রোগীদের হয়রানি, ভুল চিকিৎসা কিংবা মারধরে হত্যার মতো এ ধরনের কোনো ঘটনার পরই জানা যায় যে হাসপাতালটি অবৈধ? লাইসেন্স প্রদান আর হাসপাতাল পরিদর্শনের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাহলে কী করছে?
মাইন্ড এইড হাসপাতালে নির্মমভাবে প্রাণ হারানো আনিসুল করিম শিপন ৩১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। পেশাগত জীবনে তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩তম ব্যাচের সাবেক এই ছাত্রের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। সর্বশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন তিনি। এই পুলিশ কর্মকর্তার ভাই রেজাউল করিম সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, পারিবারিক ঝামেলার কারণে তার ভাই মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে মাইন্ড এইড হাসপাতালে যান। কাউন্টারে ভর্তির ফরম পূরণ করার সময় হাসপাতালটির কয়েকজন কর্মচারী তাকে দোতলায় নিয়ে যান। এর কিছুক্ষণ পর তাদের জানানো হয় আনিসুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। এরপর তারা আনিসুল করিমকে দ্রুত হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের অভিযোগ, ভর্তির পরপর হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শিপনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করায় মৃত্যুর আগে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন তারা। কিন্তু মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির তেজগাঁও জোনের ডিসি হারুন অর রশীদ বলেছেন ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনায় আমাদের কাছে স্পষ্ট মনে হয়েছে, এটা একটা হত্যাকাণ্ড। যে ১০-১২ জন লোক তাকে পিঠ বেঁধে, মুড়ে, আছড়ে নিয়ে গেছে, তারা কেউ ডাক্তার নন।
বরিশালে চাকরিরত অবস্থায় মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়ার পর এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে প্রথমে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে কারা কীভাবে তাকে আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে গেল এ বিষয়টি স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছে। আনিসুলের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে এবং আদাবর থানা মামলাটি তদন্ত করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদিকে, আনিসুল করিম শিপনের মৃত্যুর দিন সোমবারই নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে হাসপাতালটির ১৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় ইতিমধ্যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা পুলিশের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন বলেও দাবি করেছে পুলিশ। আনিসুলের মৃত্যুর পর পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে যে, হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য বৈধ কাগজপত্র ছিল না। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এই হাসপাতাল মানসিক রোগীর চিকিৎসার নামে বাণিজ্য করে আসছিল। পুলিশ আরও জানিয়েছে, হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে কোনো রোগীর এমন নির্মম মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে অবিলম্বে এএসপি আনিসুল করিম শিপনের মৃত্যুর সুষ্ঠ তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার জরুরি। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, কভিড-১৯ মহামারীর চিকিৎসায় সরকার নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর কয়েকটির যথাযথ লাইসেন্স না থাকার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হয়। কিন্তু এরপরও হাসপাতাল-ক্লিনিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নজরদারির কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। কদিন আগেই দেশ রূপান্তরে ‘অস্ত্রোপচার করেন ওটিবয়’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে রাজধানীর তিনটি হাসপাতালের অনৈতিক ও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসার খবর প্রকাশিত হয়। সে সময় র্যাবের অভিযানে হাসপাতাল তিনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীর হয়রানি কিংবা লাশ হয়ে ফেরার এমন ঘটনা বন্ধে সারা দেশে মানহীন হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের জোরদার উদ্যোগ জরুরি।
সম্পাদকীয় : দেশ রুপান্তর
আপনার মতামত জানানঃ