ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল ১০৬৬ সালে উইলিয়াম নামে এক ব্যক্তির ইংল্যান্ড জয়ের মধ্য দিয়ে। এরপর স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসসহ আরো কয়েকটি রাজ্য মিলে একটা বিশাল ব্যাপ্তি পায়। এরপর রাষ্ট্রটিতে প্রধানমন্ত্রীর শাসন শুরু হলে রাজা শুধু একটি অলঙ্কারিক পদে পরিণত হয়। রাজপরিবার ব্রিটেনের আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে।
তবে সময়ের পরিবর্তনে এখন মানুষের মনোভাব পাল্টাতে শুরু করেছে। ঐতিহ্যবাহী রাজতন্ত্রে আর আগ্রহ নেই ব্রিটিশ তরুণদের। তারা বরং চান একজন ‘হেড অব দ্য স্টেট’, যিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। গত দুই বছরে রাজতন্ত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনায় তরুণদের মাঝে রাজতন্ত্রের প্রতি এ তিক্ত মনোভাব দেখা দিয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ব্রিটেনের রাজপরিবার। রানি এলিজাবেথের স্বামী ৯৯ বছর বয়সী প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু এবং এপ্রিলে রাজপরিবার থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে যাওয়া প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগানের সাক্ষাৎকারে এমন কিছু কথা বেরিয়ে এসেছে, যা রাজপরিবারের সদস্যদের জন্য সুখকর ছিল না।
তবে প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে শোকাহত ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রতি বহু মানুষের সহানুভূতি থাকলেও ব্রিটেনের সব মানুষই কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজতন্ত্রের পক্ষে নয়।
প্রশ্ন করা হলে বেশিরভাগ মানুষ বলেন, তারা একটি রাজপরিবারের যে ঐতিহ্য এবং প্রতীকী তাৎপর্য সেটিকে গুরুত্ব দেন। এটি না থাকলে তারা দুঃখ পাবেন। কিন্তু ব্রিটিশ জনগণের একটি বিরাট অংশ আবার সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে দেখতে চান।
জরিপ সংস্থা ইউগভ একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে, ব্রিটেনের ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের ৪১ শতাংশের রাজপরিবার নিয়ে তেমন কোনো আবেগ নেই। তারা বরং রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটিযে একজন হেড অব স্টেট চান, যিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে একই বয়সের ৩১ শতাংশ তরুণ রাজতন্ত্রের পক্ষে তাদের মনোভাব জানিয়েছে। তারা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে একজন রাজা বা রানিকে চান।
এই চিত্র মাত্র দুই বছরের আগের চিত্র থেকে অনেকটা পৃথক। দুই বছর আগে রাজতন্ত্রের পক্ষে ছিল ৪৬ শতাংশ, আর বিপক্ষে ছিল ২৬ শতাংশ। তবে সামগ্রিক জরিপে কিন্তু আবার রাজতন্ত্রের পক্ষেই বেশি মানুষের সমর্থন দেখা গেছে। সেখানে বর্তমানে ৯৫ বছর বয়সী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও তার পরিবারের পক্ষে অনুকূল মনোভাব দেখিয়েছে ৬১ শতাংশ মানুষ। মাত্র ২৫ শতাংশ এর পরিবর্তন চেয়েছে।
আগের জরিপগুলোতে দেখা গেছে, তরুণদের কাছে প্রিন্স হ্যারি আর মেগানই বয়স্ক দম্পতি ফিলিপ আর দ্বিতীয় এলিজাবেথের চেয়ে বেশি প্রিয়। প্রিন্স হ্যারি ও মেগানের প্রতি ফিলিপ ও এলিজাবেথের নেতিবাচক মনোভাব তরুণদের পছন্দ হয়নি।
ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বয়স এখন ৯৪ বছর। গত প্রায় এক হাজার বছর ধরে কোন না কোন ভাবে ব্রিটেনে তাদের শাসন চালু আছে। মাঝখানে একবারই মাত্র এতে ছেদ ঘটেছিল, সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের পাঁচ বছর।
ব্রিটেনে রাজা বা রানির বেশ কিছু সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন পার্লামেন্টের তৈরি আইনে সই করা, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা এবং পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকা। কিন্তু রাজতন্ত্রের অনেক ক্ষমতাই এখন খর্ব করা হয়েছে।
রানি এলিজাবেথ একই সঙ্গে কমনওয়েলথের সদস্য ৫৪টি দেশেরও রানি। এই জোট গড়ে উঠেছে একসময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন দেশগুলোকে নিয়ে।
ডার্বির বাসিন্দা কার্সটেন জনসন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আমাদের আর রাজতন্ত্রের দরকার নেই। আমি বুঝতে পারি না এটা রেখে লাভটা কী। এটা আসলে ভিন্ন একটা সময় আর উপনিবেশবাদের একটা ঘোর ছাড়া আর কিছুই নয়।
তার মতে, সরকার চালানোর জন্য নির্বাচিত লোকজন আছে, কাজেই রাজতন্ত্র কেন দরকার? কাগজে-কলমে রানিকে সবকিছু সই করতে হয়, কিন্তু আসলে তিনি তো কেবল আলংকারিক প্রধান আর তার পেছনে দেশের খরচও কম নয়।
২০২০ সালে রাজপরিবারের পেছনে ব্রিটেনের করদাতাদের সাড়ে ৯ কোটি ডলার খরচ হয়েছে। রাজপরিবারের পক্ষ থেকেই দেয়া হয়েছে এই তথ্য। এটি এযাবতকালের সর্বোচ্চ ব্যয়।
রাজপরিবারের পেছনে ব্যয় করা এই অর্থকে বলা হয় রাজকীয় মঞ্জুরি। রানির কাজ-কর্ম, তার পরিবারের ব্যয়, রাজপরিবারের ভ্রমণ এবং রাজপ্রাসাদগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ নির্বাহ করা হয় এই তহবিল থেকে।
ব্রিটেনের বিভিন্ন অংশের মধ্যেও রাজপরিবারের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় ধরনের তারতম্য দেখা যাচ্ছে এই জরিপে। স্কটল্যান্ডের মাত্র অর্ধেক মানুষ রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। ব্রিটেনের কোন একটি অঞ্চলে রাজপরিবারের ব্যাপারে এত কম সমর্থন আর দেখা যায়নি। তবে সবাই রাজতন্ত্র পুরোপুরি বিলোপের পক্ষে নন। অনেকেই আংশিক সাংবিধানিক সংস্কারের পক্ষে।
অবশ্য জরিপের ফল প্রকাশ হওয়ার পর এর প্রতিক্রিয়া ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে রাজতন্ত্র যে তরুণদের কাছে আগ্রহ ও আনুগত্য হারাচ্ছে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ