অনেক হাসপাতালেই শয্যা খালি নেই। রোগীর স্বজনেরা ছুটছেন এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে। গুরুতর অসুস্থ যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন, তাদের অনেককেই আবার পড়তে হচ্ছে অক্সিজেন-সংকটে। হাসপাতালগুলোয় এসব সংকট প্রতিদিনই প্রকটতর হচ্ছে। সর্বোপরি বলা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। দিনরাত চিতা জ্বলছে শ্মশানগুলোয়। সব মিলিয়ে ক্রমেই বিশ্বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কেন্দ্র হয়ে উঠছে ভারত।
দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ভারতে এখন করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের এ পরিস্থিতি এখন উদ্বেগ ছড়াচ্ছে বাংলাদেশেও। কারণ ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই সবচেয়ে বড় সীমান্ত বাংলাদেশের। এছাড়া বাংলাদেশীদের যোগাযোগও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি।
পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে করোনা সংক্রমণের হার ৯.৫%। রাজ্যটির স্বাস্থ্য দপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যের বরাত দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় পশ্চিমবঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১৫ হাজার ৯৯২ জনের। এ ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর আগে রোববার এ সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৮৮৯। অন্যদিকে গতকাল রাত পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যটিতে ৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কেন লকডাউন ঘোষণা হবে না
এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের চিকিৎসকরা প্রশ্ন তুলছেন, পশ্চিমবঙ্গে কেন লকডাউন ঘোষণা হবে না? চিকিৎসকদের আরও বলছেন, এর পরও ২৯ এপ্রিল রাজ্যে শেষ দফার নির্বাচন আছে। ২ মে ভোট গননা। তাই করোনা সংক্রমণের হার রাজ্যে যে এই দু’দিনের জনসমাগমের ফলে আরও বাড়বে সেই বিষয়ে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত। কেননা নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা না মেনে লাগামছাড়া ভিড় ও গায়ে গায়ে দাঁড়িয়েই নেতাদের আহ্বানে মানুষ ভোটের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। শেষ দফার নির্বাচন ও গণনার দিনও যে এর ব্যতিক্রম হবে না সেটাই স্বাভাবিক।
তবে এর পরেও স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কর্তারা ও রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্তারা মনে করছেন, এই মুহূর্তে রাজ্যে লকডাউন করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় রাতে কার্ফু জারি করা। লকডাউন ও রাতে কার্ফু জারি করা সম্ভব না হওয়ার এক ও অন্যতম কারণ হচ্ছে নির্বাচন ও তার পরবর্তীতে ভোট গণনা। তবে এরই মধ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়ে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে চিন্তিত চিকিৎসকরা। তবে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে এবং রাজ্যের চিকিৎসা পরিকাঠামো ভেঙে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা সব মহলের। কী করে বাড়তি সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে সেই চিন্তাও ভাবাচ্ছে স্বাস্থ্যকর্তাদের।
পরিমবঙ্গেও একাধিক ধরন শনাক্ত
ভারতে বর্তমানে করোনার বেশ কয়েকটি ধরন সক্রিয়। পশ্চিমবঙ্গেও করোনার একাধিক ধরনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। সেখানকার সংক্রমণ পরিস্থিতি বর্তমানে বাংলাদেশেও বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই সবচেয়ে বড় সীমান্ত বাংলাদেশের। সাংস্কৃতিক নৈকট্যের কারণে এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে বাংলাদেশীদের ঘনিষ্ঠতাও সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিনই স্থলসীমান্ত দিয়ে এপার-ওপার বাংলায় আসা-যাওয়া করছে অসংখ্য মানুষ। বর্তমানে স্থল ও আকাশপথে ভারতীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সীমান্ত পারাপার বন্ধ থাকলেও বাণিজ্য চালু রয়েছে।
সীমান্তবর্তী জেলাগুলো দিয়ে এগুলোর সংক্রমণ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টদের।তাদের ভাষ্যমতে, এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করাটাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ভারত থেকে আসুক বা অন্য যেকোনো দেশ থেকে আসুক; ভাইরাস ঠেকাতে নিজেদের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
ভারত রোধ করতে পারলে আমাদের কমবে এমন চিন্তা না করে যে পদক্ষেপগুলো আমরা বিভিন্ন সময়ে নিয়েছি সেগুলো চলমান রাখতে হবে। যেমন আইসোলেশন, স্বাস্থ্যবিধি মানা, টিকা কার্যক্রম চলমান রাখা ইত্যাদি। ভাইরাস নতুন বা পুরনো হোক তা মোকাবেলার পদক্ষেপ একই ধরনের। এগুলো অব্যাহত রাখা গেলে তখন আমরা বলতে পারব, ভারতের হোক বা অন্য কোনো দেশের হোক সেটা আমরা রুখে দিতে সমর্থ হয়েছি।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, দুই সপ্তাহ আগেও পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৪ হাজারের কাছাকাছি। বিষয়টি ওই সময়েই সেখানকার স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ এ সংখ্যা ছিল ওই সময়কার রেকর্ড। এর পর থেকে শনাক্তের রেকর্ড ভাঙতে ভাঙতে বর্তমান পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সংক্রমণ পরিস্থিতি।
প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে করোনার সক্রিয় ধরনগুলোর মধ্যে একটিতে ঊ৪৮৪ক শীর্ষক এক মিউটেশন চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী করোনার সবচেয়ে মারাত্মক ধরনগুলোর মধ্যে এ মিউটেশন দেখা গিয়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চে) পশ্চিমবঙ্গে মোট সংক্রমণের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত এ নতুন ধরনের মিউটেশন সংবলিত ধরনটি দায়ী হতে পারে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
অক্সিজেনের সংকটের আশঙ্কা
পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গেও অক্সিজেনের মারাত্মক সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছে রাজ্য সরকার। গত সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রতিদিন ভারতের অন্যান্য অংশে ২০০ টন অক্সিজেন সরবরাহের নির্দেশনা দিয়েছিল ভারতের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ। এতে আপত্তি জানিয়ে কলকাতা বলছে, পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে এখানেই দৈনিক ৪৫০ টন অক্সিজেনের প্রয়োজন হবে। এ অবস্থায় প্রতিদিন ২০০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গেই অক্সিজেনের সংকট তীব্র হয়ে উঠবে। এরই মধ্যে রাজ্যে অক্সিজেনের সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অক্সিজেনের সরবরাহ চালু রাখতে ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুম চালু রাখার উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে ৯৩টি অক্সিজেন প্লান্ট তৈরি করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এর মধ্যে পাঁচটির অনুমোদনও মিলে গিয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।
অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ জ্যামিতিক হারে বাড়ায় স্থানীয় হাসপাতালগুলোয়ও মারাত্মক চাপের সৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতালগুলোয় শয্যাসংখ্যা বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না রাজ্য সরকার। নতুন করে আরো ২০ হাজার শয্যা বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় করোনার উপসর্গ তীব্র হওয়ার পরই হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছে রাজ্য সরকার। এ নিয়ে নতুন একটি নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৫১৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি।[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ