সাংবাদিকরা সমাজের অনিয়ম দুর্নীতি অসঙ্গতির চিত্র তুলে ধরেন। এর মধ্য দিয়েই তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করেন। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকরা যদি খবর প্রকাশের অধিকার হারায় তাহলে সমাজ ভারসাম্য হারাবে। পুরো ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে দুর্বৃত্তরা। তেমন হলে গণতন্ত্র তো দূরের কথা রাষ্ট্রীয় ঐক্য ধরে রাখাও কঠিন হবে। দেখা যাচ্ছে, দেশে সাংবাদিকতা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। সাংবাদিকদের ওপর নানা ধরনের নিপীড়ন ক্রমেই বাড়ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এক সাংবাদিককে গুম করে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের পর দুর্বৃত্তরা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় ফেলে যায়। চেতনা ফিরে পেয়ে তিনি আর্তনাদ করে বলছিলেন, ‘প্লিজ আমাকে আর মারবেন না, আমি আর নিউজ করব না।’ সারা দেশেই সাংবাদিকদের ওপর এভাবে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো তাদের ওপর নেমে আসছে আইনের খড়গও।
খবরে জানা যাচ্ছে, নিউজ পোর্টাল সিটি নিউজবিডি ডটকমের নির্বাহী সম্পাদক ও সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের চট্টগ্রাম ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার গোলাম সারোয়ারকে ১ নভেম্বর অচেতন অবস্থায় রাস্তা থেকে উদ্ধার করে সাধারণ মানুষ। এর আগে ২৮ অক্টোবর রাতে নগরীর ব্যাটারি গলির বাসা থেকে চন্দনাইশের বাড়িতে যাওয়ার পথে তিনি অপহৃত হন। চার দিন নিখোঁজ থাকার পর তাকে পাওয়া যায় সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরার একটি রাস্তার পাশে। তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সাংবাদিক নেতারা হাসপাতালে দেখা করে জানিয়েছেন, গোলাম সারোয়ারের কাছ থেকে যে বক্তব্য পাওয়া গেছে পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য তা আতঙ্কের। অপহরণ করার পর তাকে একটি আস্তানায় নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেখানে হাত পা চোখ মুখ বেঁধে তার ওপর নির্যাতন চালায়। অন্য দিকে, পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। আলামত পর্যালোচনা করে দেখছে তারা। তারা অপেক্ষা করছে সাংবাদিক সারোয়ারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার জন্য। একজন সাংবাদিককে এভাবে অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন করা গুরুতর অপরাধ। এ ঘটনার অনেক ক্লু রয়েছে। পুলিশ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে অপরাধীদের চিহ্নিত করা কঠিন হওয়ার কথা নয়। ঘটনার আট দিন অতিবাহিত হলেও দেখা যাচ্ছে তদন্ত আশাপ্রদ অগ্রসর হয়নি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে জানা যাচ্ছে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ২১৯ জন সংবাদকর্মী হামলার শিকার হয়েছেন। এ ধরনের হামলার ঘটনাগুলো দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির প্রভাবে ঘটছে। ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী লোকদের ইশারা ইঙ্গিতে বা প্রত্যক্ষ মদদে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়রানি ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে। অন্য দিকে, সরকারের তৈরি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও তাদের জন্য বড় হাতিয়ার হয়েছে। ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, জুন পর্যন্ত এ আইনে ৫৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরো ভয়াবহ। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় গ্রেফতার হওয়ার আগেই তিনি গুম হয়ে যান। ৫৩ দিন গুম থাকার পর অসুস্থ অবস্থায় পুলিশ তাকে আবার আটক করে। তার প্রতি সদয় হওয়ার জন্য ফ্রান্স ভিত্তিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে; কিন্তু তার দুর্ভোগ কমার এখনো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
ক্ষমতাসীনদের বহুমুখী চাপে এ দেশে সাংবাদিকরা নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেই কাজ করে যাচ্ছেন। তার পরও তাদের ওপর নেমে আসছে নিপীড়ন নির্যাতন। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা রক্ষায় সরকার তার অঙ্গীকার রক্ষা করছে না। উপরন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করা হয়েছে। এই আইন ক্রমেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত করছে। এ অবস্থা কোনোভাবে ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। দমন পীড়ন ও অধিকার হরণের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সমাজও ঐক্যবদ্ধ নয়। সবাই জোটবেঁধে মাঠে নামতে পারছে না। তারা যদি নিজ পেশার স্বাধীনতা রক্ষায় জোরালো ভূমিকা নিতে না পারেন, তাহলে তারা কিভাবে জনসাধারণের জানার অধিকার সংরক্ষণ করবেন?
আপনার মতামত জানানঃ