নাসির উদ্দিন রকি : চট্টগ্রামে ‘অপহরণ ও নিখোঁজের’ তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনায় নগরীর থানাগুলোয় ৬ মাসে অন্তত অর্ধশত সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করা হয়েছে। কারও কারও সন্ধান মিললেও অনেকেই দীর্ঘদিন ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন। এসব ব্যক্তিকে ফিরে পেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দফতরে ধরনা দিচ্ছেন স্বজনরা। পাশাপাশি তাদের ফিরে পেতে সংবাদ সম্মেলনও করছেন স্বজনরা। ‘অপহরণ ও নিখোঁজের’ ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ ও স্বজনদের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
২৯ অক্টোবর নগরীর কোতোয়ালি থানার ভিআইপি টাওয়ারের সামনে থেকে অপহরণের শিকার হন সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার। ঘটনার চারদিন পর ১ নভেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে মুমূর্ষু অবস্থায় সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা এলাকায় তাকে পাওয়া যায়। এ ঘটনায় সরোয়ার বুধবার অপহরণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। তবে ওই ঘটনায় কারা জড়িত, কেনই বা তাকে অপহরণ করা হয়েছিল, সে বিষয়ে গোলাম সরোয়ার নিজেও যেমন কোনো ধারণা দিতে পারছেন না, তেমনই পুলিশও অন্ধকারে।
এদিকে সাংবাদিক সরোয়ার ফিরে এলেও চার মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছেন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র প্রান্ত ভট্টাচার্য অনিক (১৮)। তাকে ফিরে পেতে বুধবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন স্বজনরা। প্রান্তর পিতা ত্রিদীব ভট্টাচার্য সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাসার নিচে যাওয়ার কথা বলে ২৬ জুন পাথরঘাটার ইকবাল রোডের বাসা থেকে বের হয় প্রান্ত। এরপর থেকে সে আর ফিরে আসেনি। পরদিন কোতোয়ালি থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়। থানা পুলিশের পাশাপাশি তারা ডিবি, পিবিআই ও র্যাব-৭ এর কাছেও ছেলের সন্ধান চেয়ে আবেদন করেছেন। কিন্তু এখনও খোঁজ মেলেনি তার।
অপরদিকে দুই সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ রয়েছেন রেজাউল হক নামে এক যুবক। ২০ অক্টোবর কাজে যাওয়ার জন্য কোতোয়ালি এলাকার বাসা থেকে বের হন রেজাউল। এরপর থেকে আর হদিস নেই তার। নগরীর মাঝির ঘাটে অবস্থিত আল আরাফাত নামে একটি লবণের মিলে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন তিনি। রেজাউলের ভাই মো. রিদোয়ান জানান, তার অফিস সময় হচ্ছে সকাল ৯টা থেকে। সকাল ১০টার পরও অফিসে না পৌঁছায় কর্মস্থল থেকে বাসায় ফোন করা হয়। এরপর ভাইকে ফিরে পেতে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি। আত্মীয়স্বজনের বাসা-বাড়িসহ সম্ভাব্য সব স্থানে তাকে খোঁজা হয়েছে।
নিখোঁজ দু’জনকে উদ্ধারে তৎপরতা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সিএমপির উপপুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক বলেন, ‘তাদের উদ্ধারে মেন্যুয়াল এবং টেকনোলজিক্যাল যত কার্যক্রম আছে, সবই হাতে নিয়েছি। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি একটা ভালো রেজাল্ট দিতে পারব।’
এদিকে দেড় যুগে চট্টগ্রামে বেশ ক’জন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষার্থীসহ অন্তত শতাধিক লোক অপহরণ ও গুমের শিকার হয়েছেন। যাদের অনেকেই এখনও বাড়িতে ফেরেননি; এমনকি মেলেনি লাশও। গুমের শিকার ব্যক্তিরা কোনো একদিন পরিবারের মাঝে ফিরে আসবেন- এমন আশায় বুক বেঁধে আছেন স্বজনরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাতে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার সামনে থেকে অপহৃত হন ঠিকাদার মোজাফফর আহমদ চৌধুরী। ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর গুম হন নুরুল আজিম। ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল নগরীর খুলশী থানা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর শ্রীকান্ত রক্ষিত হত্যাসহ ১৬ মামলার আসামি আজিমউদ্দিন মাহমুদ। নগরী খুলশি থানাধীন ভূঁইয়া গলির মুখ থেকে ২০১০ সালের ২৭ মার্চ র্যাব পরিচয়ে একটি সাদা মাইক্রো বাসে করে তুলে নেয়া হয় রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু জাফরকে। এরপর থেকে তার সন্ধান মেলেনি। ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর রাতে ঢাকা থেকে অপহরণের শিকার হন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপি সভাপতি ও করলডেঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর নগরী থেকে নিখোঁজ হন তোহেল আহমেদ (১৭)। ২০১৫ সালের ৩ জুলাই ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের আলোচিত শিপব্রেকিং ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন কুসুম। ২০১৬ সালে সিটিগেট এলাকা থেকে ঢাকা ডিবির লোক পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় পরিবহন ব্যবসায়ী শামীম সরদারকে। তাকে গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্ত্রী চম্পা বেগম।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি নিখোঁজের বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হলে প্রথমত দেশের সব থানায় এবং হাসপাতালগুলোয় বিষয়টি অবগত করা হয়। এর পাশাপাশি প্রযুক্তির সহায়তায়ও নিখোঁজ ব্যক্তিকে খোঁজা হয়। তবে গুম বলে পুলিশে কোনো বিষয় নেই। আছে অপহরণ ও নিখোঁজ। দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ যেসব ব্যক্তি এখনও বাড়ি ফিরে আসেননি, তাদের বিষয়েও একইভাবে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।’
সূত্র : যুগান্তর
আপনার মতামত জানানঃ