এই প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে মানুষ এবং বানরের কোষের মিশ্রণে ভ্রূণ তৈরি করল। গত বৃহস্পতিবার বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘দ্য জার্নাল সেল’-এ এই ভ্রূণ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
যেখানে এই গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত বিজ্ঞানীরা বলেন, তাদের এই গবেষণা কৃত্রিমভাবে মানুষের অঙ্গ তৈরিতে নতুন পথ দেখাবে। যাদের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে, তাদের জন্য এই গবেষণা দারুণ কিছু নিয়ে আসবে। তবে বিজ্ঞানীদের এই গবেষণাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে বিতর্ক।
রাইস ইউনিভার্সিটির বেকার ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির একজন কর্মকর্তা ক্রিস্টিন ম্যাথিউজ বলেন, “আমার প্রথম প্রশ্ন হল, কেন এই গবেষণা? আমি মনে করি সাধারণ মানুষ, এমনকি আমি এটা নিয়ে চিন্তিত। বিজ্ঞানে আমরা কোনও কিছু না ভেবেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা ভাবছি না, আমাদের কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়।”
যদিও এখনও অব্দি এই গবেষণার সাথে জড়িত বিজ্ঞানীরা এবং জীবনীতিশাস্ত্রের কিছু লোক এই গবেষণার পক্ষেই কথা বলছেন।
লা জোলাতে বায়োলজিকাল সায়েন্সের সাল্ক ইন্সটিটিউটের জিন এক্সপ্রেশন ল্যাবরেটরির একজন অধ্যাপক এবং ‘সেল স্টাডি’-এর সহ-লেখক জুয়ান কার্লোস বলেন, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় ধরণের অসুবিধা। যদিও এখানে চাহিদার তুলনায় যোগান অনেক কম।
এই ধরনের গবেষণা আমার কাছে নীতিগত ভাবে সমস্যার মনে হয় না, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং কেইস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির বায়োএথিস্ট ইনিসু হুয়ান বলেন। এই ধরনের গবেষণা মানবিক উচ্চাকাঙ্খা থেকেই হয় এবং তা যথার্থ।
অঙ্গ প্রতিস্থাপন না করাতে পেরে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়, হুয়ান উল্লেখ করেন। এজন্য সম্প্রতি বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গবেষক ভেড়া এবং শূয়রের ভ্রূণে মানব কোষ ইনজেক্ট করে দেখতে চায় এই সব প্রাণীর শরীরে মানব অঙ্গ তৈরি হয় কিনা প্রতিস্থাপনের জন্য।
কিন্তু এখন অব্দি গবেষকদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তাই কার্লোস চীন এবং আরও কিছু দেশের বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটা দল গঠন করে ভিন্ন কিছু চেষ্টা করে দেখার জন্য। এই গেবষক দল ম্যাকাক বানরের শরীরে ২৫ টি প্রবর্তিত পুরিপোটেন্ট স্টেম সেল ইনজেকট করে। এই সেলগুলোকের সাধারণ আইপিএস সেল (iPS cells) বলা হয়। ম্যাকাক বানর জেনেটিক্যালি ভেড়া বা শূয়রের থেকে মানুষের অনেক কাছাকাছি।
কার্লোস বলেন, একদিন পর, গবেষকরা জানায়, ১৩২ টি ভ্রূণতে তারা মানবকোষ শনাক্ত করতে পেরেছে এবং ভ্রূণগুলো ১৯ দিন অব্দি তারা অধ্যয়ন করেছিল। যা বিজ্ঞানীদের জানতে সাহায্য করেছিল, কীভাবে প্রাণী এবং মানুষের কোষের মধ্যে সংযোগ ঘটানো সম্ভব। যা কিনা অন্যান্য প্রাণিদের শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য মানব অঙ্গ তৈরির গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল।
কার্লোস এনপিআর-কে বলেন, আমরা আনন্দিত। এই গবেষণা আমাদের অন্যান্য প্রাণীর শরীরে মানব কোষ গঠনে সফল পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে।
এই ধরনের মিশ্র প্রজাতির ভ্রূণকে ‘চিমেরাস’ বলা হয়। এই নামকরণ করা হয় গ্রীক মিথলজির মুখ থেকে আগুন বের করা প্রাণীর নামানুসারে। যেটা একই সাথে সিংহ, ছাগল এবং সাপ।
‘আমাদের উদ্দেশ্য অন্য কোন জীব বা কোন দানব জন্ম দেয়া না এবং আমরা অমন কিছু করছিও না। আমরা জানার চেষ্টা করছি ভিন্ন জীবের সাথে মানব কোষ কীভাবে সম্পর্ক তৈরি করে।’
কার্লোস আরও বলেন, তিনি আশা করেন এই ধরনের গবেষণা আমাদের মানুষের বিকাশ, বৃদ্ধ হওয়া এবং ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগের কারণ জানতে সাহায্য করবে। এনপিআর-এর অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও মনে করেন, এই গবেষণা ফলপ্রসূ হতে পারে।
মিশিগান ইইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি এবং ইমিউনোলজি’র অধ্যাপক ড. জেফরি প্ল্যাট বলেন, এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। এই পথ অনুসরণ করে আমরা একদিন হয়তো একদিন হার্ট বা কিডনি বা ফুসফুস তৈরি করতে পারবো।
উল্লেখ্য, ড. জেফরি প্ল্যাট এই ধরনের গবেষণার সাথে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। তবে তিনি নতুন এই গবেষণার সাথে জড়িত নন।
কিন্তু এই ধরণের গবেষণার কিছু প্রতিবন্ধকতা সবসময় থাকে। কিছু প্রশ্ন সবসময় ওঠে। সবথেকে বড় বিতর্ক, যেটা বিশ্বাসীরা করে থাকে, এই গবেষণা থেকে প্ররোচিত হয়ে কেউ যদি এমন কোন ভ্রূণ থেকে মানবশিশু জন্ম দিতে চায়! বিশেষভাবে এই প্রশ্নকারীরা এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যে মানব কোষ এই ধরনের কোন ভ্রূণর মস্তিষ্ক বিকাশের অংশ হতে পারে। মানব মস্তিষ্ক হতে পারে এই গবেষণার থেকে জন্ম নেয়া প্রাণীর।
“এটা কি মানুষ হিসেবে নিয়ন্ত্রিত হবে কারণ এর মধ্যে মানব কোষের একটি বড় অংশ রয়েছে নাকি এটি প্রাণী হিসেবেই বিবেচিত হবে?, রাইস ইউনিভার্সিটির ম্যাথিউজ বলেন।
আরও একটু উদ্বেগ হল, এভাবে মানবকোষ ব্যবহার করলে প্রাণীটার মানুষের শুক্রাণু অথবা ডিম হতে পারে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়োএথিস্ট হ্যাংক গ্রিলি বলেন, “প্রকৃতপক্ষে কেউ চায় না মানব ডিম বা শুক্রাণু বিয়ে বানর ঘুরে বেড়াক। কারণ যদি মানব শুক্রাণু বয়ে বেড়ানো একটি বানর মানব ডিমের একটি বানরের সাথে মিলিত হয়, তাহলে কী হবে ভাবুন! কেউ চায় না বানরের গর্ভাশয়ে মানব ভ্রূণ বেড়ে উঠুক।”
কার্লোর এই নীতিগত সমস্যাগুলো মেনে নেন। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেন, তার দলের মানুষ এবং বানরের মিশ্র ভ্রূণ দিতে এমন কোন প্রাণী তৈরির ইচ্ছে নেই যেটা অংশত মানুষ। এমনকি মানব অঙ্গ তৈরিরও চেষ্টা তারা করছে না। তিনি বলেন, তিনি এবং তার দল গ্রিলি সহ বায়োএথিস্টদের সাথে কথা বলেছেন।
গ্রিলি বলেন, তিনি এই আশা করছেন এই কাজটা একজন বিজ্ঞানী তার গবেষণায় কতদূর অব্দি যেতে পারবেন, তা নিয়ে বিতর্ককে উস্কে দেবে।
বেশ কয়েক বছর ধরেই জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা এই ধরনের কাজ ও গবেষণায় অর্থসংস্থানের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার কথা ভাবছে। পাশাপাশি নতুন কিছু গাইডলাইন আরোপ করা হবে। যেটা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর স্টেম সেল রিসার্চ থেকে আগামী মাসে হতে পারে বলে ধারণা করে হচ্ছে।
এছাড়া, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অন্য প্রাণী থেকে অঙ্গের ব্যবহার ভাইরাস ছাড়াতে পারে। তাই এই গবেষণা যদি সফল হয়, তাহলে এই সংক্রমণ ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরনের গবেষণার জন্য ব্যবহৃত প্রাণীদের আলাদা করে রাখা হয় এবং প্রতিস্থাপনে ব্যবহৃত যেকোন অঙ্গও সতর্কতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ