আওয়ামী সরকার হেফাজতে ইসলামের বিষয়ে অনেকটাই নমনীয় ছিলো। বিভিন্ন সময় তাদের কিছু দাবি-দাওয়াও মেনে নিয়েছে। হেফাজতও এই সুযোগে নিজেদের অনেক দাবি-দাওয়া আদায় করে নিয়েছে। সরকার হেফাজতের ঢোলের তালে নেচে আসলেও এবার ভিন্ন সুর বাজছে।
গত বছর হেফাজত ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে এবং কুষ্টিয়াতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য টেনেহিঁচড়ে নদীতে ফেলে দেওয়ার মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ হুমকি দেন হেফাজতের নেতারা। এর পর সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দু ধর্মালম্বীদের বাড়িঘর ও মন্দিরে ভাঙচুর করা হয়। এরপর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতের তাণ্ডবে সরকার বিব্রত ও বিরক্ত। তাই হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ভিডিও ফুটেজ দেখে ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে চাপে ফেলে সংগঠনটির নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রয়েছে বলে জানা গেছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে ২৬ মার্চে এবং তার পর কয়েক দিন ধরে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের কর্মসূচি থেকে ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয় এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সেই সময় হেফাজতের নেতাকর্মীরা সরকারি অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেন এবং ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় লিপ্ত হন। হেফাজতের নেতাকর্মীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুরালসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। রেললাইন, রেলস্টেশন, ভূমি অফিসসহ সরকারি বিভিন্ন অফিস, থানায় হামলা ও অস্ত্র লুট, ইউএনও অফিস, আওয়ামী লীগ অফিস, বাড়িঘর কোনো কিছুই হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ থেকে বাদ পড়েনি।
সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এই সব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ রয়েছে সরকার ও প্রশাসনের হাতে। এই ভিডিও ফুটেজ দেখে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই কিছু সংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও মাঝারি সারির কিছু নেতাকেও আইনের আওতায় এনে শীর্ষ নেতাদের প্রতি একটা বার্তা দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে গত সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট চারজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো। চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ আরও কয়েকজন পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু বলে জানা গেছে।
এসব ধ্বংসাত্মক ঘটনায় অর্ধশতধিক মামলা হয়েছে হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এছাড়াও ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজত অবস্থান নিয়ে যে তাণ্ডব চালায় তারও মামলা রয়েছে। সেই মামলাগুলোও সক্রিয় করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ধ্বংসযজ্ঞে সরাসরি যারা জড়িত এবং যারা নেতৃত্ব ও নির্দেশ দিয়েছন তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। এই প্রক্রিয়া থেকে হেফাজতের শীর্ষ নেতাও বাদ পড়বেন না। তাদেরও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হতে পারে বলে সূত্রগুলো জানায়।
গত ১৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, যারা ধর্মের নামে স্বার্থ হাসিলের নোংরা রাজনীতি করছে এবং সম্পদ নষ্ট করছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের ধরা হচ্ছে।
এর আগে গত ৪ এপ্রিল জাতীয় সংসদের অধিবেশনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছিলেন ভিডিও ফুটেজ দেখে তাণ্ডবে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সব দিক থেকে চাপে ফেলে সংগঠনটির নেতৃত্বে আগের মতো একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ জন্য রমজান মাস ও করোনার কারণে চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে কাজে লাগানো হবে। হেফাজত যেকোনো পরিস্থিতিতে মূলত মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যবহার করে থাকে। কওমি মাদ্রাসাগুলো এখন রমজানের ছুটিতে রয়েছে। তাই এ সময়টাকে হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মোক্ষম সময় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া হেফাজতের নেতৃত্বের আইনি ব্যবস্থা জোরদার করার ক্ষেত্রে সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বিতর্ক সরকারের জন্য সহায়ক হয়েছে। বিষয়টি সাধারণ মানুষের মধ্যে মুখরোচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যা হেফাজত নেতাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। কেন্দ্রীয় অন্য নেতাদেরও ‘দুর্বল’ দিক খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি আর্থিক কেলেঙ্কারি, মাদ্রাসা পরিচালনায় অনিয়ম, মাদ্রাসার তহবিল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম থাকলে সে বিষয়গুলোও সামনে আনা হবে।
এই চাপে হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলেও তাদের মধ্যে একটা ফাটল ধরানো যাবে বলে মনে করেন সরকারি দলের একটা অংশ। আবার কেউ কেউ নরমে-গরমে পরিস্থিতি মোকাবিলার পক্ষে। চাপ তৈরির পাশাপাশি প্রয়োজনমতো পর্দার অন্তরালে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার কৌশল নেওয়া হবে বলে সরকারি একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।
এসব নিয়ে অবশ্য হেফাজত ইতিমধ্যেই দ্বিধাবিভক্ত এবং ক্ষুব্ধ। অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তায় ভর করেছে সংগঠনটির বেশিরভাগ নেতার ওপর। একটি অংশ সরকারের সঙ্গে আপস না করে ‘লড়ে যাওয়ার’ পক্ষে। আরেকটি অংশ চায়, ভেবে-চিন্তে পথ চলতে। তাদের টার্গেট; সরকার এবং বিরোধী—উভয়পক্ষের সঙ্গে সখ্য রেখে হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসা হস্তক্ষেপমুক্ত রাখা। রাজনীতির মাঠে লড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে মসজিদ-মাদ্রাসা আর খানকাহ রক্ষায় সচেষ্ট এই পক্ষ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হেফাজত নিকট অতীতে আওয়ামী লীগের মিত্র শক্তি হিসেবেই কাজ করেছে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে সরকারের সখ্য সবার জানা। শফীর জীবদ্দশায়ও মাঝে মধ্যে এই সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। আবার উন্নতিও হয়েছে। শফীর মৃত্যুর পর সম্পর্কের টানাপোড়েন বেশ প্রতিভাত হয়েছে। রাজনীতির মাঠে হেফাজত নানা সময়ে নানাজনের কাছে ব্যবহার হয়েছে। বিগড়ে গেলে নিয়ন্ত্রণে আনতে ‘একটু এদিক-সেদিক’ করতে হয়। এখন সেই পরিস্থিতিতেই পড়েছে তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৮
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ