ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতের সহিংস তাণ্ডব ও হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে ফাটল দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব ও মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডসহ অন্যান্য অভিযোগের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন সংগঠনটির নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। আজ মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের সভাপতি ও বাহাদুরপুরের পীর। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডের পর তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগসহ আরও নানা কারণ দেখিয়ে মাওলানা আব্দুল্লাহ হেফাজত ইসলামের নায়েবে আমীরের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
মামুনুল হকের রিসোর্ট কেলেঙ্কারিতে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান ছিল তুমুল বিতর্কিত। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও রয়্যাল রিসোর্টে কথিত স্ত্রীসহ অবরুদ্ধ হওয়া এবং এর পরবর্তী সময়ে নানা ঘটনায় বিতর্কিত যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে নিয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় কোনো আলোচনা না হওয়া এবং সাংগঠনিক দায়মুক্তি পেয়ে মামুনুল হকের হেফাজতে বহাল থাকার ঘটনায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষসহ হেফাজতের অনেক নেতাকর্মী।
মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান নিজের পদত্যাগের ঘোষণায় বলেন, হেফাজতে ইসলাম এখন কিছু ব্যক্তির ‘নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের একটি প্ল্যাটফর্ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, “বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমি হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর পদ থেকে ইস্তফা প্রদান করলাম। আমার ইস্তফা প্রদানে কে বেজার হল, কে খুশি হল- এটা আমার দেখার বিষয় নয়, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমার হেফাজতে ইসলাম থেকে ইস্তফা প্রদান ইসলাম, দেশ ও জাতির অধীকতর কল্যাণের লক্ষ্যে।”
আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান বলেন, এখন থেকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কোনো ধরনের কর্মকাণ্ডের দায়ভার তিনি বা তার দল বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন নেবে না।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হাটহাজারীর বড় মাদ্রাসার দীর্ঘদিনের মহাপরিচালক আহমদ শফী, যার নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
মৃত্যুর আগের দিন মাদ্রাসায় তুমুল হট্টগোলের মধ্যে শফী মহাপরিচালকের পদ ছাড়তে বাধ্য হন। তার ছেলে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক আনাস মাদানিকেও বহিষ্কার করা হয়।
পরে ১৫ নভেম্বর শফীর অনুসারীদের বিরোধিতার মধ্যেই হেফাজতে ইসলামের সম্মেলন হয়, তাতে আমির পদে আসেন জুনাইদ বাবুনগরী।
সংবাদ সম্মেলনে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান আরও বলেন, আমি নিজের অনুভূতি ও উপলব্ধি থেকে বলছি, হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ইন্তেকালের পর হেফাজতে ইসলামে যোগ্য নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। দলাদলি সৃষ্টি হয়েছে নিজেদের মধ্যে। বিভিন্ন দল ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ অনুপ্রবেশ করেছে এবং তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে হেফাজতে ইসলামকে অত্যন্ত সুকৌশলে মাঠে নামানোর চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে হেফাজতে ইসলামকে তারা অনেকটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিতর্কিত বহিরাগত সংগঠনের লোকজনই হেফাজতে ইসলামের নেতাদের অধিকাংশের মতামত উপেক্ষা করে হরতালের মতো কর্মসূচি পালনে বাধ্য করেছে।
তিনি বলেন, “বিগত কয়েকদিন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২০ জন নিহত ও অসংখ্য আহত হওয়ায় আমি গভীরভাবে ব্যথিত হয়েছি। বাংলাদেশ সরকারসহ সর্বস্তরের জনগণকে উক্ত নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার আহবান জানাচ্ছি।”
কওমি মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়ার পাশাপাশি ‘নিরীহ আলেম ওলামাদের’ হয়রানি না করার আহ্বান জানান ফরায়েজী আন্দোলনের সভাপতি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ভারতের সরকারপ্রধান নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফর ঘিরে মার্চের শেষ দুই সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ ও হরতালের নামে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায় হেফাজত। এর প্রতিক্রিয়ায় কিছুদিন আগে সংগঠন ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন আরেক নায়েবে আমির আবদুল আউয়াল। পরে অবশ্য অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর আবার স্বপদে ফিরে আসেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হেফাজতের মধ্যকার নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলের ঘা এখনো শুকোয়নি। তাই এই বিভাজন। একদল চাইছে মাঠে থাকতে অন্যদল চাইছে অসহিংসতা। হেফাজতে ইসলামে ঐক্যমত ও আদর্শের বালাই নেই বলে দলটির নেতৃত্বে এমন বিশৃঙ্খলা দেখা যায় বলে জানান বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলেন, দেশের সবকটা রাজনৈতিক দলই স্বার্থের রাজনীতি করে। ফলে আদর্শের বাইরে গিয়ে তারা স্বার্থোদ্ধারে মরিয়া। হেফাজত ইসলামও তেমনি একটি দল। হেফাজতে ইসলামে ঐক্যমত ও আদর্শের বালাই নেই বলে দলটির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে জানান তারা।
তারা বলেন, ক্ষমতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা দলটি ইতিমধ্যে ধর্মের সংস্পর্শ থেকেও দূরে সরে গেছে। আওয়ামী লীগের সংস্পর্শে কিংবা প্রশ্রয়ে এসে তারাও ক্ষমতার রাজনীতিতে নেমেছে। তাদের এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কুফল গত কয়েকদিনের ব্যাপক জ্বালাও পোড়াও তাণ্ডব দেখে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মন থেকেও ইতিমধ্যে উঠে গেছে দলটি। মোদীবিরোধী আন্দোলনে নেমে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন প্রতিকৃতিতে আগুন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সংগীতাঙ্গনে ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক তাণ্ডবে বিরক্ত ধর্মপ্রাণ দেশবাসী। তারা ধর্মের নামে দেশে এই ব্যাপক অগ্নি নির্যাতন মেনে নিতে পারেনি।
বিশ্লেষকরা বলেন, হেফাজত ইসলাম কেবলি একটি রাজনৈতিক দল। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মত ধর্মকে ব্যবহার করলেও ধর্ম নিয়ে তাদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই যতটা আছে ক্ষমতার্জন নিয়ে, দেশবাসী ইতিমধ্যে তা উপলব্ধি করেছে। তাই বিভিন্ন জায়গা থেকে হেফাজতে ইসলাম নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ