রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে আলোচিত ‘শিশু’ বক্তা মাওলানা রফিকুল ইসলামকে আটক করা হয়েছে। আজ বুধবার দুপুরে নেত্রকোনা থেকে র্যাবের একটি দল তাকে আটক করে। ‘শিশু’ বক্তা হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানীকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে তার নানা ঘটনা। এক নারীকে তিনি বিয়ে করেছেন বলে যে দাবি করেছেন তা নিয়েও নানা তথ্য পাওয়া গেছে। ওই নারীর সঙ্গে রফিকুলের সামাজিকভাবে বিয়ে হয়নি।
বুধবার দুপুরে গ্রেপ্তার করা হয় ২৬ বছর বয়সী রফিকুল মাদানীকে, এরপর বিকেলে তার বিরুদ্ধে গাজীপুরের গাছা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আনে মামলা হয়। হেফাজতে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র্যাব, তার মোবাইল ফোনও তল্লাশি করা হয়।
র্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, রফিকুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে তার ফোনে তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু পর্নো ভিডিও পাওয়া গেছে। আসমা বেগম নামের এক নারীকে তিনি বিয়ে করেছেন বলে যে দাবি করেছেন তা নিয়েও নানা তথ্য পাওয়া গেছে। ওই নারীর সঙ্গে রফিকুলের সামাজিকভাবে বিয়ে হয়নি। বিয়ে নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।
এদিকে সকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা জায়গায় তার পরিচিত ও ভক্তরা অভিযোগ করে আসছিলেন, বুধবার (০৭ এপ্রিল) রাত ৩টার দিকে ‘শিশুবক্তা’ মাওলানা রফিকুল ইসলাম নেত্রকোণাকে তার নিজ বাসা থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। এছাড়া মাওলানা রফিকুল ইসলামের সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘আমাকে গুম করার চেষ্টা চলছে।’
এরপর দুপুরের দিকে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন ‘মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী র্যাবের নিরাপত্তায় রয়েছে মর্মে নিশ্চিত হয়েছি। অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করছি।’
গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এলাকায় রয়েল রিসোর্ট মাওলানা মামুনুল হকসহ এক নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফেসবুক লাইভে এসে মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী মামুনুল হকের সমর্থনে কথা বলেন। ফেসবুক লাইভে এসে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী নানা বক্তব্য দেন তিনি।
এদিকে মাদানীকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়ার প্রতিবাদে বুধবার (৭ এপ্রিল) বিকেলে নেত্রকোনা প্রেস ক্লাব ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করেন হেফাজতে ইসলামের স্থানীয় নেতারা। এসময় তারা মাদানীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করে বলেন, তাকে মুক্তি না দেয়া হলে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।
রফিকুল ইসলাম মাদানীর বড় ভাই রমজান মিয়া জানান, মাদানী মঙ্গলবার রাতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে ধর্মীয় সভা করে নিজ বাড়ি আসেন। রাতের খাবার শেষে সবাই ঘুমিয়ে যান। রাত ২টা ২০ মিনিটের দিকে র্যাব পরিচয়ে কিছু লোক প্রায় ১৯টি গাড়ি নিয়ে তাদের বাড়ি ঘেরাও করেন। পরে রফিকুল ইসলাম মাদানী, তার বড় ভাই বকুল মিয়া (৩৭) ও তার দূর সম্পর্কের ভাতিজা এনামুল হককে (২৮) তুলে নেয়া হয়। পরে বকুল মিয়াকে ওই রাতে ছেড়ে দিলেও অন্যদের আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
রমজান মিয়ার দাবি, এসময় মাদানীর ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোনসহ তাদের পরিবারের ছয়টি মোবাইল ফোন জব্দ করে নিয়ে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ফোনগুলো বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে রফিকুল ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সদস্য ও জেলা শহরের মালনী এলাকায় জামিয়া ইসলামিয়া হুসাইনিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর কাইয়ুমসহ আরও অনেকে।
এর আগে গত ২৫ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদের মোদিবিরোধী মিছিল থেকে ‘শিশুবক্তা’ রফিকুল ইসলামকে পুলিশি হেফাজতে নিয়েছিল। পরে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওই দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন ঘিরে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদের একটি মিছিল রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংকি এলাকায় শুরু হয়। এতে পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। মিছিলটি মতিঝিলে যাওয়ার পর পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় রফিকুল ইসলামকে পুলিশ তাদের হেফাজতে নিয়েছিল।
রফিকুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণায়, থাকেন গাজীপুরে। তিনি নেত্রকোণার পশ্চিম বিলাশপুর সাওতুল হেরা মাদরাসার পরিচালক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রফিকুল ইসলাম মাদানীরা পাঁচ ভাই। তাদের মধ্যে মাদানী সবার ছোট। তার বাবার নাম মৃত শাহাবুদ্দিন। মাদানী নেত্রকোনার মালনী এলাকায় জামিয়া ইসলামিয়া হুসাইনিয়া মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে লেখাপড়া করাকালেই ‘শিশুবক্তা’ হিসেবে আলোচিত হন।
‘শিশু বক্তা’ হিসেবে হঠাৎ পরিচিত হয়ে ওঠা রফিকুল ইসলাম কিছুটা অস্বাভাবিক খর্বকায়, বালকসুলভ চেহারা ও কোমল কণ্ঠস্বরের অধিকারী। তার নিজের ভাষ্যমতে, ‘১৯৯৫ সালে আমার জন্ম। কে বলছে আমি শিশু? আমার বয়স ২৬ বছর।’
রফিকুল ইসলামের বাড়ি নেত্রকোনায়। স্থানীয় স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হলেও পরে তিনি মাদ্রাসায় ভর্তি হন ও নূরানি, হেফজ পড়েন। এরপর আট বছর কিতাবখানায় পড়েন।
মাদ্রাসার ছাত্র থাকার সময় বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ করতেন রফিকুল। তিনি দাওরায়ে হাদিস পড়েছেন রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসায়। একই সঙ্গে তিনি বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের অঙ্গসংগঠন যুব জমিয়তের নেত্রকোনা জেলার সহসভাপতি। নেত্রকোনার পশ্চিম বিলাশপুর সাওতুল হেরা মাদ্রাসার পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছেন ‘শিশু বক্তা’।
রফিকুলের নামের শেষে ‘মাদানী’ শব্দ যুক্ত করা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সাধারণত সৌদি আরবের মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করেন, তাদের নামের সঙ্গে ‘মাদানী’ যুক্ত করা হয়। অভিযোগ, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করেই নিজের নামের সঙ্গে ‘মাদানী’ শব্দ যুক্ত করেছেন তিনি।
এরই মধ্যে ‘মাদানী’ শব্দ প্রত্যাহার করতে রফিকুলকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী। তার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শরীফুল হাসান খান গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই নোটিশ পাঠান।
বিতর্কিত বক্তা হওয়ায় রফিকুল ইসলামকে ওয়াজকারী বক্তাদের সংগঠন রাবেতাতুল ওয়ায়েজিন বাংলাদেশের সদস্য করা হয়নি। বরং সংগঠনটির পক্ষ থেকে তাকে বিভিন্ন সময় অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কদিন আগে ঘটা মাওলানা মামুনুল হকের নারী গঠিত ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি, এরইমধ্যে রফিকুল মাদানির বিয়ে নিয়ে ধুম্রজাল। হুজুর মাওলানাদের এসব অসামাজিক কার্যকলাপে সমাজের এর প্রভাব পড়ে। তারা বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে মানুষদের ধর্মীয় শিক্ষা দেবেন আর নিজেদের বেলায় থাকবেন খোল্লাম খোল্লা, এসব নৈতিকতাবোধের তুমু স্খলন। তাদের এইসব ভণ্ডামির ব্যাপারে মানুষকে জানতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কে এইচ/ ২১১৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ