করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার যে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছে সেটি তৃতীয় দিনের মাথায় এসে কার্যত ভেঙ্গে পড়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ আরোপ করেছে সরকার। ৫ এপ্রিল থেকে এই বিধিনিষেধ পালনের মেয়াদকাল শুরু হয়। চলবে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত। এই সময়ে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কথা থাকলেও ঘরে বসে নেই মানুষ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফার নির্দেশনা ভেঙে পড়েছে। কারণ হলো সমন্বয়হীনতা। গতবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগালেও হতো। কিন্তু এবার হুট করে কী ধরনের বিধিনিষেধ দেওয়া হলো যা একেবারেই সাংঘর্ষিক। কী প্রয়োজন কী প্রয়োজন নেইতা নিয়ে গবেষণা নেই। প্রজ্ঞাপনে স্বাস্থ্যবিধি কীভাবে রক্ষা করা যায় তা স্পষ্ট নেই।
উচ্চ সংক্রমণে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া উচিত ছিল। প্রথম দিন যখন দেখল নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না, তখনই বসে আলোচনা করা যেত। আবার সংক্রমণ বাড়ছে, কেউ জানে না পরবর্তী পদক্ষেপ কী? এতে তো জনগণের মধ্যে হতাশা এসে পড়বে। তারা বৃহস্পতিবারের মধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন তৈরির পরামর্শ দেন।
লকডাউনে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা
লকডাউনের দ্বিতীয় দিনেও স্বাভাবিক চলাচল ছিল সাধারণ মানুষের। পাড়া-মহল্লায় চায়ের দোকানে আড্ডা, রাস্তায় অযথা ঘোরাঘুরি কিংবা খেলাধুলা করার মতো ঘটনা চোখে পড়েছে। আর গণপরিবহন না থাকায় গাদাগাদি করে রিকশা, ভ্যানগাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা কিংবা ভ্যানগাড়ি করেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছে মানুষ।
তৃতীয় দিনে আজ বুধবার থেকে গণপরিবহন চলাচল করছে। তাতে ‘বিধিনিষেধ’ অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। কোথাও নেই স্বাস্থ্যবিধি পালনের নমুনা। সামাজিক দূরত্ব বলতে কিছুই নেই। সকালে অফিস টাইমে মানুষের চাপ বেশি থাকলেও দিনের চিত্র অন্যান্য দিনের মতোই। অনেকেই রাস্তায় বের হয়েছেন ‘লকডাউন’ কেমন চলছে সেটার দেখার আগ্রহ নিয়ে।
তার পিছু পিছু বাজারের দিকে যেতেই চোখে ছানাবড়া। বাজারে ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। ক্রেতা কয়েকজনের মুখে মাস্ক থাকলেও বিক্রেতা কারও মুখে নেই মাস্ক। সেখানে নেই সামাজিক দূরত্ব পালনের কোনও ব্যবস্থা। বাজারের সবজি বিক্রেতা ইউনুস মিয়ার কাছে মাস্কের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওইসব গরিব মানুষের হয় না। আর কাস্টমার তো দূরেই থাকে। সমস্যা নাই। এতদিন কিসু হয় নাই আর কী হইবো এখন?’
শুধু হাট-বাজার নয়, উন্মুক্ত স্থানে কিংবা পথের মধ্যেও মানুষের স্বাস্থ্যবিধি পালনের নজির আছে খুব কম। আর সামাজিক দূরত্ব মানার অভ্যাস নেই বললেই চলে। যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকা ঘুরে দেকা গেছে, সব ধরনের দোকানই খোলা। হোটেল, চাইনিজ, ফল, কাপড় সব দোকানই খোলা। ফুটপাতে শত শত দোকান খোলা। সে কারণে দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটার সুযোগও নেই। গাদাগাদি করে মানুষ হাঁটছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে চলছে আড্ডা।
কি বলছে সরকার
সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, আজ-কালের মধ্যে নির্দেশনায় আরও পরিবর্তন আসবে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গতকাল বলেন, সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। তিনি বলেন, দুই/একদিনের মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পরিকল্পনায় কোনো ঘাটতি ছিল কি নাএ প্রশ্নে ফরহাদ হোসেন বলেন, “জনগণের সুরক্ষার জন্যই এই ১১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ছিল সংক্রমণ এবং মৃত্যুর রেকর্ড। পরিস্থিতি খারাপ হলে সরকার পূর্ণ লকডাউনে যাবে কি না এই প্রশ্নে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, কাল-পরশু এ ব্যাপারে ঘোষণা আসবে।
এদিকে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতার কথা তুলে ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে ঢাকার সব হাসপাতালে শয্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করছি। আড়াই হাজার শয্যাকে পাঁচ হাজার করা হয়েছে, এরচেয়ে বেশি বাড়ানো সম্ভব না। জনগণ সতর্ক না হলে মনে রাখতে হবে, পাঁচ হাজার শয্যার পর হাসপাতালগুলোতে এক ইঞ্চি জায়গা নেই আর শয্যা স্থাপনের। তিনি বলেন, দেশের জনগণের জন্যই লকডাউন। আমি আশা করি, জনগণ নিষেধাজ্ঞা মেনে চলবেন। প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে, জনগণ সচেতন হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
সরকারের নেওয়া বিধিনিষেধ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, সাত দিনের লকডাউনের তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে আন্তঃজেলায় যে সংক্রমণ ছড়াত, সেটা কিছুটা কমবে। ঢাকা থেকে সংক্রমণ বাইরে ছড়াতে পারত এবং সেটা আরও খারাপ হতে পারত সেটা কিছুটা কমবে। কারণ, যান চলাচল বন্ধ।
কিন্তু ঢাকা শহরেই দুই কোটির মতো মানুষ বাস করে। ঢাকা শহরে যেগুলো ছড়াচ্ছে, সেটা তো থামানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। যে অবস্থা দেখছি, ধীরে ধীরে সরকারের লকডাউনের বিরোধিতা, ক্ষোভ বাড়ছে। তার মানে শহরের ভেতর ছড়ানোর যে ব্যবস্থা, সেটা বজায় থাকল। যারা অফিসে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে কেউ আক্রান্ত, সে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাবেই নিশ্চিত। আবার বাস থেকে আক্রান্ত হয়ে ভাইরাস বাসায় নিয়ে গেল। বাসার লোক আক্রান্ত হবে। এভাবে একটা সংক্রমণ চক্র চলতেই থাকবে।
ডা. মুশতাক আহমেদ বলেন, সরকার আর্থ-সামাজিক দিক বিবেচনা করে এই ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। এটা কার্যকর করতে পারলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এখন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ধরে কড়াকড়ি করতে হবে। হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এই লকডাউনের ফলে সংক্রমণ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরকারের দেওয়া ১১ দফা নির্দেশনাতেই সুপরিকল্পনার ছাপ নেই। এ কারণেই প্রথম দিনই কঠোর নির্দেশনা ভেঙে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে দ্বিতীয় দিন আরও নমনীয় হয়ে গণপরিবহন খোলা রাখার সিদ্ধান্তে আসতে হয়েছে।
সরকার এখন লকডাউন দিয়েছে কিছুটা বাধ্য হয়ে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছে এটা একটা সহজ পদ্ধতি। তারা আর বেশি কিছু জানে না। তারা মনে করে এতে কিছু গাড়ি-ঘোড়া চলবে না, অফিস-আদালত বন্ধ হবে, এতে জনস্বাস্থ্যের কিছু নেই। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টা হলো পুরো সংক্রমণ কীভাবে হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণে কী রকম ব্যবস্থাপনা হবে, সবগুলো যদি একসঙ্গে না নেওয়া যায়, তাহলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪২১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ