আশরাফুল ইসলাম : অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটিরশিল্পে ঋণ বিতরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানছে না ব্যাংকগুলো। নির্ধারিত ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দুই দুইবার সময় দেয়া হয়েছিল ব্যাংকগুলোকে। কিন্তু সময় বাড়িয়েও লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও বিতরণ করা হয়নি। ইতোমধ্যে ৩১ অক্টোবরের সর্বশেষ দেয়া সময়ও শেষ হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ২২ অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ২৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাই নিরুপায় হয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ব্যাংকগুলোকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আবারো সময় দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পোদ্যোক্তাদের সহায়তায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণের জন্য গত ১৩ এপ্রিল এক সার্কুলার জারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সার্কুলারে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটিরশিল্পে ঋণ বিতরণের জন্য ভালো ব্যাংক ও দুর্বল ব্যাংক বিভক্ত করে আলাদা আলাদাভাবে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। প্রথমে ব্যাংকগুলোকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু ওই সময় পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে বিদেশী ব্যাংকসহ প্রায় দুই ডজন ব্যাংক এক টাকাও ঋণ বিতরণ করেনি। সার্বিক অবস্থা নিয়ে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সাথে গভর্নর ফজলে কবিরের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে এমডিদের ঋণ বিতরণের সময়সীমা দুই মাস বাড়িয়ে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বেঁধে দেয়া হয়।
বলা হয়, এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ ঋণ বিতরণ করতে হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা বেশির ভাগ ব্যাংকই আমলে নেয়নি। শতভাগ ঋণ বিতরণতো দূরের কথা কোনো কোনো ব্যাংক এক টাকাও ঋণ বিতরণ করেনি। যারা করেছে তাদের বেশির ভাগই ১০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। কয়েকটি ব্যাংক বেশি হারে ঋণ বিতরণ করার পরও ২২ অক্টোবর শেষে এসে অর্জিত হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর এ ব্যর্থতার ফলে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটিরশিল্প খাতে কাক্সিক্ষত উৎপাদন ও সেবা প্রসারে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে শিল্পে কর্মফল বহালসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শিল্প কারখানায় কর্মবল বহাল রাখতে ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আরো এক মাস সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো বড়দের ঋণ বিতরণে যতটা না আগ্রহী, ছোটদের ঋণ বিতরণে ততটাই অনাগ্রহী। কারণ, ব্যাংকগুলোর আমানতের সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ করে দেয়া না হলেও ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশের বেশি হারে ঋণের সুদহার আরোপ করতে পারছে না। .
ছোট ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার অজুহাতে ব্যাংকগুলো তাই ছোট ঋণ বিতরণে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অথচ বড় ঋণের চেয়ে ছোট ঋণে আদায়ের হার অনেক বেশি। কারণ ছোট উদ্যোক্তারা ব্যাংকের টাকা মেরে দেন না। যতটুকু খেলাপি হয় তা প্রকৃত ব্যবসায়ে লোকসানের কারণেই হয়। কিন্তু বড় উদ্যোক্তারা বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করেন না। এ কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ ফিরে পাওয়ার জন্য ছোট উদ্যোক্তাদের প্রতিই আকৃষ্ট হওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এর অন্যতম কারণ হলো বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালকরাই বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধার। তারাই নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যান। এ কারণে অর্থনীতির স্বার্থেই সরকারসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
ব্যাংকগুলো যেন ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে বাধ্য হয় সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় যতই সময় বাড়িয়ে দেয়া হোক না নেন কিছু কিছু ব্যাংক ঋণ বিতরণে অনাগ্রহীই থেকে যাবে।
খবর : নয়াদিগন্ত,পৃষ্ঠা ১২ / ০৩ নভেম্বর ২০২০
আপনার মতামত জানানঃ