ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনা টিকার দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করার পর থেকেই মানবদেহে গড়ে উঠতে থাকে করোনা প্রতিরোধী প্রোটিন। অন্তত প্রথম ছয়মাস পর্যন্ত টিকার সর্বোচ্চ কার্যকারিতা থাকে। করোনাভাইরাসের সবথেকে বিপজ্জনক দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়ান্টের বিরুদ্ধেও মানবদেহে প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে এই টিকার ডোজ। এক বিবৃতিতে ফাইজার ও বায়োএনটেক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের টিকার তৃতীয় পর্যায়ের মেডিকেল ট্রায়াল শেষে এই ফলাফল পাওয়া গেছে।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের টিকা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই টিকার কার্যকারিতা থাকে ৬ মাসের থেকেও বেশিদিন। কারণ টিকা গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেহে বিশেষ ধরণের কোষ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে এই টিকা।
গত বছরের নভেম্বরে মার্কিন ওষুধপ্রস্তুতকারী কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান জৈবপ্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানি বায়োএনটেক যৌথভাবে প্রস্তুত করে করোনা টিকা। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ জরুরি ব্যবহারের জন্য এই টিকার অনুমোদনও দেয়।
ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী ৪৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে ৮০০ জন ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার এবং ৯২৭ করোনারোগীর মধ্যে মধ্যে ৮ জন ছিলেন ভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনে আক্রান্ত।
আন্তর্জাতিক জীবনু বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের মতে, করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন বা বি.১.৩৫১ নামের এই ভাইরাসটি এ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া সার্স-কোভ-২ বা করোনাভাইরাসের ধরণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক।
করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকার ধরণের বিরুদ্ধে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার কার্যকারিতা ট্রায়ালে প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টর ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) ইতোমধ্যে জানিয়েছে, করোনায় গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে এই টিকা শতকরা ১০০ ভাগ কার্যকর। অপর একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে এই টিকা ৯৫ দশমিক ৩ শতাংশ কার্যকর বলে রায় দিয়েছে।’
ফাইজার কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলবার্ট বোরলা এক বার্তায় বলেন, ‘তৃতীয় পর্যায়ের মেডিকেল ট্রায়ালের ফলাফল খুবই আশাব্যাঞ্জক। এটি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘টিকার দুটি ডোজ নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মানবদেহে করোনা প্রতিরোধী প্রোটিন গড়ে উঠতে থাকে। ছয়মাস পর সেই প্রোটিন সর্বোচ্চ সক্রিয় পর্যায়ে পৌঁছায়।’
কিন্তু এর মধ্যেই টিকার প্রভাবে মানবদেহে জন্মায় বিশেষ ধরণের কোষ, যা বি সেল নামে পরিচিত। এই কোষগুলোর কাজ হলো মানবদেহে করোনাপ্রতিরোধী প্রোটিন তৈরি করা। এ কারণে টিকার ডোজের প্রোটিনের কার্যকারিতা যদি কোনো কারণে ছয় মাস পর থেকে হ্রাস পেতে থাকে, তাহলেও সমস্যা নেই। বি সেল সেই অভাব পূরণ করে দেয়।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ফাইজারের টিকা সর্বপ্রথম জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ফাইজার, মর্ডানা ও জনসনের টিকা দেওয়া হচ্ছে।
আগামী ১ মের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রাপ্ত বয়স্ক লোকজনের জন্য টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইতিমধ্যে করোনার টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে একদিনে রেকর্ড হয়েছে। ২ এপ্রিল একদিনে দেশে ৪০ লাখ ৮০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত সপ্তাহেও প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখের বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, টানা দুদিন ধরে দেশে করোনায় শনাক্ত রোগী ৭ হাজারের বেশি। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ৭৫ জনের। আর মারা গেছেন ৫২ জন। আগের দিন রোববার করোনা শনাক্ত হয়েছিল ৭ হাজার ৮৭ জনের, যা দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এক দিনে ছিল সর্বোচ্চ। গতকাল করোনার সংক্রমণে মারা গেছেন ৫৩ জন।
আজ সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল রোববার সকাল আটটা থেকে আজ সোমবার সকাল আটটা পর্যন্ত) ৩০ হাজার ২৩৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৪০ শতাংশ।
এ পর্যন্ত দেশে মোট ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৪৩৯ জনের করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯ হাজার ৩১৮ জন। মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৪১৪ জন।
গত শনিবার দেশে করোনায় সংক্রমিত ৫ হাজার ৬৮৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন। আর মারা গিয়েছিলেন ৫৮ জন। তার আগের দিন শুক্রবার শনাক্ত হয়েছিল ৬ হাজার ৮৩০ জনের। সেদিন ৫০ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের কথা জানায় সরকার। গত বছরের মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর থেকে শনাক্তের হার কমতে শুরু করে।
গত জুন থেকে আগস্ট—এই তিন মাস করোনার সংক্রমণ ছিল তীব্র। মধ্যে নভেম্বর-ডিসেম্বরে কিছুটা বাড়লেও বাকি সময় সংক্রমণ নিম্নমুখী ছিল। এ বছর মার্চে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার সংক্রমণ বেশি তীব্র। মধ্যে কয়েক মাস ধরে শনাক্তের চেয়ে সুস্থ বেশি হওয়ায় দেশে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমে আসছিল। কিন্তু মার্চ মাস থেকে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যাও আবার বাড়তে শুরু করেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ২৯ মার্চ বেশ কিছু বিধিনিষেধসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। এর মধ্যে ঘরের বাইরে গেলে মাস্কের ব্যবহার অন্যতম। কিন্তু সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকলেও জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে এখনো উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৭১৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ