বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ডাউন হয়ে আছে বেশ কয়েকদিন ধরেই। কয়েকদিন ধরে বন্ধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এখনই স্বাভাবিক হচ্ছে না। কবে খুলে দেওয়া হবে তা এখনই বলতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কমিশন-বিটিআরসি। বিটিআরসি’র ভাইস-চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র আজ সোমবার(২৯ মার্চ) বিবিসিকে এ কথা বলেছেন। তবে ফেসবুক মেসেঞ্জার স্বাভাবিক করে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা চেয়ে দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার করতে গিয়ে গত শুক্রবার(২৬ মার্চ) বিকেল থেকে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে । ফেসবুক কখনো ডাউন, আবার কখনো বন্ধ থাকায় লগ ইন করা, পোস্ট দেওয়া এবং মেসেঞ্জার ব্যবহার করে কোনো কিছু পাঠানোর ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়েছে তারা। তবে বিশ্বের ওয়েবসাইট ডাউন মনিটরিং সাইট ‘ডাউন ডিটেক্টরে’ বিশ্বের কোথাও ফেসবুক ব্যবহারে বিপত্তির তথ্য নেই।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের প্রতিবাদে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
দুদিনের সফরে বাংলাদেশ এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার এই সফরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস বিক্ষোভ হচ্ছে। সহিংসতায় তিন দিনে অন্তত ১২ জন প্রাণ হারিয়েছে। যদিও সবচেয়ে সহিংসসঙ্কুল দুটি এলাকা— ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের হাটহাজারির পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানাচ্ছেন সেখানকার কর্মকর্তারা। কিন্তু তারপরও কবে কখন ফেসবুক ব্যাবহারের উপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট করছে না বিটিআরসি।
বিবিসিকে সুব্রত রায় বলছেন, “চালু করার বিষয়ে দিন-ক্ষণ কিছু বলা যাচ্ছে না।”
ফেসবুকের তরফ থেকে শনিবারই বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে তাদের একাধিক সেবা সীমিত করার বিষয়ে অবগত আছে তারা, বিষয়টি তারা বোঝার চেষ্টা করছে এবং আশা করছে যে, দ্রুতই তাদের পূর্ণাঙ্গ সেবা আবার সচল হবে।
তবে এর দুদিন পরেও পরিস্থিতির কোন উন্নয়ন হয়নি। অনেকেই ফেসবুকে লগইন করতে পারছেন না। যাদের লগইন করা আছে তারা পাচ্ছেন না কোন আপডেট। ভালোভাবে কাজ করছে না মেসেঞ্জার সেবাও। এমনকি কোথাও কোথাও উচ্চগতির ইন্টারনেটের গতিও কমিয়ে রাখা হচ্ছে। এরকম অবস্থায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও অনলাইন-ভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।
কেন ফেসবুক ও ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত করা হচ্ছে তার কারণ খোলাসা না করলেও বাংলাদেশ টেলিকম্যুনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন বিটিআরসি’র ভাইস-চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বিবিসিকে বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুরোধে ফেসবুক বন্ধ রাখা হয়েছে’। এর বাইরে এ সংক্রান্ত কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি।
অবশ্য ফেসবুক বন্ধ করা হলেও ভিপিএন বা ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ব্যাবহার করে অনেক বাংলাদেশি ফেসবুক ব্যাবহার করছেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনাও চলছে। অনেকেই বিভিন্ন ধরণের স্ট্যাটাস দিয়ে জানাচ্ছেন যে ভিপিএন এর মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার করছেন তারা।
এদিকে এবিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গতকাল রবিবার দেশের জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরামর্শে ফেসবুক সেবা সীমিত আছে। এখনো যে অবস্থা আছে তাতে কখন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আমার তা জানা নেই। যে অবস্থা আজকেও গেছে, তাতে মনে হচ্ছে কিছুটা সময় হয়তো লাগতেও পারে।’
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কিছু ব্যক্তিগত অসুবিধার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম দিন তারা যে লাইভ অনুষ্ঠানগুলো করেছে, এগুলো ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থা যখন ভালো মনে করবে তখন ফেসবুক স্বাভাবিক হবে।’
এদিকে মোবাইল অপারেটর সূত্র জানায়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে মোবাইল অপারেটরগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন হঠাৎ করে ফেসবুক মেসেঞ্জার ডাউন করে দেওয়া বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী। তারা বলেন, বাংলাদেশ একটি বদ্ধ সমাজে পরিণত হতে চলেছে। ভিন্নমতের ওপর আক্রমণ চলছে। একতরফা নির্বাচনের পরে বাকস্বাধীনতাকে এভাবে রুদ্ধ করার প্রবণতা শুভ নয়।
তারা বলেন, সরকারের উচিত হবে বাকস্বাধীনতার যত আইনি বাধা আছে, তা দূর করা। একইসঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জার অতিসত্বর স্বাভাবিক করে দেওয়া। সেইসাথে দলীয় নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালীদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা বাড়ানোর পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা৷
তারা বলেন, বর্তমানে স্যোশাল মিডিয়া সম্পূর্ণভাবে সরকারী নজরদারির মধ্যে, এর সাথে রয়েছে ফোনকলও। এগুলোতে জাতির পিতা কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অশোভন কিছু বললে বা লিখলে গ্রেফতার হচ্ছে। আর এখন সরকারের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু হলেই সরকার ফেসবুক ডাউন করে দিচ্ছে, মেসেঞ্জার ডাউন করে দিচ্ছে। সরকারকে এইসব ফ্যাসিবাদী আচরণ থেকে বের হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শীঘ্রই ফেসবুক মেসেঞ্জার স্বাভাবিক করে মানুষের কথা বলার অধিকারকে সম্মান জানানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
এদিকে ফেসবুক বন্ধ থাকার কারণে আর্থিক ও ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনাকারী উদ্যোক্তারা।
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ। এর মধ্যে ১০ কোটির বেশি গ্রাহক মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ফেসবুক ডাউন হওয়ার কারণে এই ব্যবহারকারীদের নানা রকম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসার উদ্যোক্তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। একই সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারভিত্তিক বিভিন্ন সেবা, ভার্চুয়াল ক্লাস বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
করোনাভাইরাস মহামারি সংকটের সময় পুঁজি কমে যাওয়ায় অনেকেই ফেসবুককেই ব্যবসার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আবার অনেকের জন্য ব্যবসা পরিচালনার একমাত্র মাধ্যমই ফেসবুক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী উদ্যোক্তা, যিনি ফেসবুকে একটি পেইজের মাধ্যমে হাতে আঁকা ছবি, আয়না ইত্যাদি বিক্রি করে থাকেন, তিনি বলছিলেন, ফেসবুক বন্ধ থাকার কারণে ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে অনলাইন কেনাকাটার প্রায় অর্ধেক ফেসবুককেন্দ্রিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে হয়ে থাকে। ফেসবুক বিভ্রাটে ছোট ছোট অনলাইন উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
অবশেষে সচল হলো ফেসবুক ও মেসেঞ্জার
প্রায় ৪ দিন অচল থাকার পর অবশেষে দেশে সচল হলো ফেসবুক ও মেসেঞ্জার। আজ সোমবার (২৯ মার্চ) রাত সাড়ে সাতটার পর থেকে সহজেই ফেসবুকে প্রবেশ করা যাচ্ছে। একই সঙ্গে মেসেঞ্জারে কল এবং ছবি আদান প্রদান করা যাচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা অনেকেই ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তা জানাচ্ছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ