যুদ্ধপ্রবণ এই বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা বরাবরই অক্ষুণ্ণ থাকে। অস্ত্র চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিশ্বে অস্ত্রেরও বিশাল বাজার রয়েছে। সেখানে বিশ্বজুড়ে অস্ত্র বিক্রির তালিকায় আমেরিকা শীর্ষে রয়েছে। বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়, তার এক তৃতীয়াংশ হয় আমেরিকা থেকে। বিগত দশ বছরের তুলনায় আমেরিকায় অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে ১৫ শতাংশ। আর অস্ত্র কেনায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এখন সৌদি আরব। তাদের অস্ত্র কেনার পরিমাণ ৬১ শতাংশ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপরি)-এর এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানা গেছে। খবর ডয়চে ভেলের।
বৈশ্বিক অস্ত্র লেনদেনের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে আজ সোমবার(১৫ মার্চ) ‘ট্রেন্ডস ইন ইন্টারন্যাশনাল আর্মস ট্রান্সফার্স, ২০২০’ শীর্ষক বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সুইডেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট, সিপরি।
সিপরি জানায়, ২০০১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে যা অস্ত্র বিক্রি করত যুক্তরাষ্ট্র, এখন ১৫ শতাংশ বেশি বিক্রি করে তারা। গেল ৫ বছর বিশ্বে মোট যত অস্ত্র বিক্রি হয়েছে, তার ৩৭ শতাংশ করেছে দেশটি। ৯৬টি দেশকে অস্ত্র বিক্রি করেছে তারা। আর এই অস্ত্র বিক্রি অর্ধ শতাংশ ক্রেতা মধ্যপ্রাচ্য। যুক্তরাষ্ট্রের পর অস্ত্র বিক্রির শীর্ষে রয়েছে রাশিয়া ও ফ্রান্স।
২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বাড়েনি। তার আগের এক দশক ধরে অস্ত্র বিক্রি সমানে বেড়েছে। এর মূল কারণ চীন ও রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা কমেছে। রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ কম হওয়ার কারণ, ভারত সে দেশ থেকে অনেক কম অস্ত্র কিনছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি থেকে অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বাড়লেও সামগ্রিকভাবে অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বাড়েনি।
বিশ্বে অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে এক নম্বরে আমেরিকা। এর পর আছে রাশিয়া ও ফ্রান্স।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের অস্ত্র রপ্তানি কমেছে ৭.৮ শতাংশ। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আলজেরিয়া চীনা অস্ত্রের শীর্ষ ক্রেতা।
২০১৬ থেকে ২০২০ সালে মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র কেনার পরিমাণ তার আগের দশ বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। আর সৌদি আরবের অস্ত্র কেনার পরিমাণ ৬১ শতাংশ বেড়েছে। কাতারের অস্ত্র কেনার পরিমাণও বহুগুণ বেড়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৫০টি এফ ৩৫ জেট কেনার জন্য চুক্তি করেছে। তারা ১৮টি সশস্ত্র ড্রোনও কিনছে। দুই হাজার ৩০০ কোটি ডলার দিয়ে এই অস্ত্র কিনছে আমিরাত।
এশিয়া ও ওশিয়ানিয়ার দেশগুলো বেশি অস্ত্র কেনে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে অস্ত্রের ৪২ শতাংশ কেনা হয়েছে এখান থেকে। কিনেছে ভারত, চীন, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও পাকিস্তান।
সিপরি-র এক সিনিয়র গবেষক বলেছেন, এশিয়া, ওশিয়ানিয়ার অনেক দেশই চীনকে বিপদের কারণ বলে মনে করে। তাই তারা অস্ত্র কিনছে।
প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, করোনার ফলে অস্ত্র কেনাবেচা কমেছে কিনা, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তাদের মতে, করোনা প্রতিটি দেশের অর্থনীতিকে ধাক্কা দিয়েছে। তাই অনেক দেশই হয়তো অস্ত্র কেনার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। তবে করোনার প্রকোপ যখন সবচেয়ে বেশি ছিল, তখনো কিছু দেশ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কেনার জন্য চুক্তি করেছে।
আঞ্চলিক সংঘাত ও উত্তেজনা যতই বেড়েছে, অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ততই পোক্ত হয়েছে। দেশটি গত পাঁচ বছরে অন্তত ৯৬টি দেশে প্রধান প্রধান অস্ত্র হয় বিক্রি করেছে, না হয় ‘অনুদান’ হিসেবে পাঠিয়েছে।
সৌদি আরবের নেতৃত্বে সুন্নি অধ্যুষিত আটটি দেশ ইয়েমেনে নিজেদের পছন্দের সরকার রক্ষায় দেশটিতে হামলায় লিপ্ত। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে সৌদি জোটের বিমান হামলায় হাজার হাজার নিরীহ নাগরিক নিহত হয়েছে বলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে। ইয়েমেনে সৌদি হামলায় প্রতিদিন নিরীহ মানুষ মরছে এবং এতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে দাবি করে বেশ আগে থেকেই সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার আহ্বান জানিয়ে আসছে বিভিন্ন যুদ্ধবিরোধী ও মানবাধিকার সংগঠন। ইয়েমেনে হামলার সময় সৌদি কর্তৃপক্ষ যুদ্ধাপরাধ করেছে, এমন অভিযোগ ওঠার পর থেকে অস্ত্র বিক্রির জন্য সমালোচনা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
আরব দেশগুলোর জোট যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উৎপাদিত আধুনিক অস্ত্র ইয়েমেনে মোতায়েন করেছে। তেলের দাম কমার পরও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ভবিষ্যতে ব্যাপক হারে অস্ত্র মোতায়েন হবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট আসার সাথে সাথেই সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, এটা রুটিন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। নতুন প্রশাসন এসে আগের প্রশাসনের অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত খতিয়ে দেখে।
তাই সৌদি ও আরব আমিরাতকে অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত এবার খতিয়ে দেখা হবে। তারপর ঠিক হবে, সেই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে, না কি তা বাতিল হবে।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের খবর বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের ওই দুই দেশে কোটি কোটি ডলারের অর্থ বিক্রি সাময়িক স্থগিত করে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন, যার মধ্যে সৌদির কাছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলার অস্ত্র প্রিসিজন-গাইডেড মিউনেশন ও আমিরাতের কাছে এফ-৩৫ বিমান বিক্রিও রয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের শপথ নেয়ার এক সপ্তাহ পরে এমন সিদ্ধান্ত এসেছে। নির্বাচনী প্রচারে সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক পুর্নমূল্যায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।
এসডব্লিউ/কেএইচ/২১৫১
আপনার মতামত জানানঃ