দেশের নাগরিকদের পরিচয় নিশ্চিত করতে সরকার জাতীয় পরিচয়পত্রের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু সে পরিচয়পত্রে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য ভুল। এ পরিচয়পত্রে দেখা যায় ব্যক্তির নাম ভুল, জেলার নাম ভুল, পোস্ট অফিস ভুল, গ্রাম ভুল ইত্যাদি। এ ধরনের সমস্যার কারণে বিড়ম্বণায় পরছেন সাধারণ জনগণ। এমন ভুলে ভরা এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) স্মার্টকার্ড নিয়ে ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে জনগণকে।
ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ৬৭ হাজার ৭৬৪টি সংশোধনী আবেদন জমা পড়ে আছে। এর বাইরে গত বুধবার পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৫১৩টি আবেদন ঝুলে ছিল শ্রেণি নির্ধারণের অপেক্ষায়। চার শ্রেণিতে ভাগ করে আবেদন নিষ্পত্তি করে ইসি।
সম্প্রতি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে বিতরণ করা হয়েছে স্মার্টকার্ড। কিন্তু অধিকাংশ স্মার্টকার্ড ভুলে ভরা। এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নাগরিকরা। প্রবাসী অধ্যুষিত এ উপজেলার মানুষকে এমন কার্ড নিয়ে দেশ-বিদেশে বেশ বিড়ম্বনাতেই পড়তে হবে আবার, লালমনিরহাটের আদিতমারীর বালাপুকুর উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক লক্ষ্মীকান্ত রায় করোনা টিকা নিবন্ধন করতে গিয়ে দেখেন ২০১৪ সালের ৩ জুন তিনি মারা গেছেন।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ভুলে ভরা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতে গিয়ে দিশেহারা শত শত নাগরিক। দিনের পর দিন ধরনা দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। উপজেলার আট ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় শত শত নাগরিক জাতীয় পরিচয়পত্রে নামের ভুল, নামের বানান ভুল, ভুল ঠিকানা, বয়সের ভুল, বাবা-মায়ের নামের ভুলসহ নানা ধরনের ভুলের বোঝা নিয়ে অস্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছেন।
সাভারের বাসিন্দা শামসুন্নাহারের স্বামীর নাম জালাল উদ্দিন। জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) স্বামীর নাম ছাপা হয়েছে হালাল উদ্দিন। এই ভুল সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তিনি ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেছিলেন। ৫ বছর ৪ মাস পার হলেও তিনি সংশোধিত পরিচয়পত্র হাতে পাননি। জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় তিনি একটি ব্যাংক হিসাবও খুলতে পারছেন না।
পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর বলেন , আমার নাম মো. জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু ভোটার তালিকা ও পরিচয়পত্রে নাম রয়েছে শুধু জাহাঙ্গীর। আমার জন্মতারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ৮১ সাল, আইডি কার্ডে রয়েছে ৭২ সাল। এ দোষ কি আমার? কমিশনের দোষ এখন আমার ওপর চাপানো হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন অফিসে তিনি দিন ধরে ঘুরছি, কিছু করতে পারছি না।
ইসির বিধিমালা অনুযায়ী, আবেদনের তারিখ থেকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশন সন্তুষ্ট হলে সংশোধন করে তা আবেদনকারী বা তার আইনানুগ অভিভাবককে জানানোর কথা। আবেদন নামঞ্জুর হলে সেটিও যথাশিগগির আবেদনকারীকে জানানোর কথা।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, সংখ্যার দিক থেকে দেড় লাখ অনেক বড়। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়। একই সঙ্গে অনেকে নানা ধরনের অনিয়ম, অবৈধ সুবিধা নেওয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করেন। যে কারণে আইনকানুন খুব কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হয়। তিনি বলেন, কিছু অনিয়ম থাকতে পারে। তাঁরা চেষ্টা করছেন যতটুকু সম্ভব দ্রুত সংশোধনের কাজ শেষ করতে।
এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ১১ কোটির বেশি ভোটারকে ইসি সেবা দেয়। এনআইডি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রয়োজন। শুরুতে এটি ছিল না, এখনো পূর্ণাঙ্গ কাঠামো নেই। যারা কাজ করছেন, তাদের সিংহভাগ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আসা। জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবার কাজটি সুচারুভাবে করতে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল, অবকাঠামো ও তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রয়োজন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করার সুযোগ আছে কি না, সেটাও দেখা প্রয়োজন।
২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে এনআইডি সংশোধনে হয়রানি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সরকারি দলের সাংসদ মোজাফ্ফর হোসেন। জবাবে সংসদ কাজে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, সংশোধনের জন্য প্রাপ্ত আবেদনসমূহের চাওয়া অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক ও বাস্তবতাবিবর্জিত। ফলে ওই সব আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যথাযথ প্রমাণপত্র/দলিলাদি দাখিলসহ ক্ষেত্রবিশেষ তদন্ত, পুনঃ তদন্তের প্রয়োজন পড়ে। দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। এ কারণে বিশেষ করে সাংবাদিক মহল বিরাগভাজন হয় এবং এ-সংক্রান্ত সেবা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে, যা সম্পূর্ণ সত্য নয়।
আইনমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, কিছু কিছু নাগরিক উদ্দেশ্যমূলকভাবে জন্মতারিখ পরিবর্তন করতে আবেদন করে থাকেন, যা একেবারেই অযৌক্তিক। একই ব্যক্তি নিবন্ধনকালে একটি জন্মতারিখ দেন, আবার সংশোধনের জন্য ভিন্ন জন্মতারিখ উল্লেখিত জন্মসনদ/উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়/কারিগরি/মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সনদ জমা দিয়ে জন্মতারিখের পরিবর্তন চান, যা সংশোধনের ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করে এবং ওই সনদে উল্লেখিত বয়সের সঙ্গে ব্যক্তির বাস্তবিক বয়সের মিল থাকে না।
ইসি সূত্র জানায়, একদিকে সব প্রয়োজনীয় কাগজ ও দলিল থাকা সত্ত্বেও যেমন অনেকে এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে ভোগান্তির মধ্যে আছেন, অন্যদিকে মিথ্যা তথ্য দিয়েও অনেকে সহজেই একাধিক এনআইডি করছেন বা পরিচয়পত্র সংশোধন করছেন। আবার অনেকে বিভিন্ন ভাতা, জমিজমা দখল, চাকরিতে সুবিধা নেওয়াসহ নানা কারণে ভুয়া প্রমাণক তৈরি করে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি কার্ড দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক কার্ডে তথ্য ভুল থাকায় সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় চাকরি হচ্ছে না, কেউ বেতন পাচ্ছেন না, কেউবা ব্যাংকের নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না। পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় অনেক হতদরিদ্র ভিজিএফসহ বিভিন্ন ত্রাণ নিতে পারছেন না। কার্ডের তথ্য সংশোধনের জন্য গুনতে হচ্ছে টাকা। সঙ্গে ভোগান্তি তো আছেই। কার্ড সংশোধনে মাসের পর মাস ও অনেক ক্ষেত্রে বছরও লেগে যাচ্ছে। এমন অবস্থার জন্য দায়ী কে? অদক্ষ কর্মী ও দায়িত্বে অবহেলার জন্য এই ভুলের ছড়াছড়ি। যখন জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয় তখন ইসির অদক্ষ কর্মীরা তথ্য সংরক্ষণে যে ভুল করেছেন তারই কারণে আজকে নাগরিকদের এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১১৪৯
আপনার মতামত জানানঃ