থানার পুলিশ হয়ে পরিচয় দিতেন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কর্মকর্তা হিসাবে আর ডিবির পরিচয়েই এরা ছিনতাই চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করতেন। মাদক ব্যবসাসহ আশুলিয়া এবং এর আশপাশের এলাকায় ডিবি পরিচয়ে নানা অপকর্ম করছিল এই চক্রের সদস্যরা। পুলিশের সদস্য ও সোর্স নিয়ে গঠিত এই চক্রটি ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীতে একজন ফার্মেসি ব্যবসায়ীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায়ের সময় হাতেনাতে ধরা পড়ার পর ফাঁস হয় তাদের অপরাধের নানা কাহিনি। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী নূর উদ্দিন আশুলিয়া থানায় একটি মামলাও করেন। এতে কনস্টেবল মমিনুর রহমান এবং এসআই সাজ্জাদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। মামলার এজাহার এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
চাঁদাবাজির ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ২২ জুলাই। ২৬ জুলাই তারা গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের পর জানা গেল, তাদের একজন আশুলিয়া থানার কনস্টেবল মমিনুর রহমান। আর যে মাইক্রোবাস ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করছিলেন, ওই গাড়ির মালিক আশুলিয়া থানার এসআই সাজ্জাদুর রহমান। কনস্টেবল মমিনুরের সঙ্গে গ্রেপ্তার অন্য তিনজন হলেন মো. আ. হামিদ, মো. ওয়াহেদ ও ওয়াজেদ শেখ।
র্যাব জানায়, তাৎক্ষণিকভাবে মাইক্রোবাস তল্লাশি করে ১৭০ পিস ইয়াবা, ৪৮০ গ্রাম গাঁজা এবং ৩১টি এক হাজার টাকার জালনোটও উদ্ধার করা হয়। এসআই সাজ্জাদুর রহমানের মাইক্রোবাস দিয়ে আশুলিয়া এবং এর আশপাশের এলাকায় ডিবি পরিচয়ে নানা অপকর্ম করছিল এই চক্রের সদস্যরা। এ ঘটনায় আশুলিয়া জামগড়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মেসির মালিক ব্যবসায়ী নূর উদ্দিন আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করেন। এই মামলার তদন্ত করছে র্যাব-৪। এ ঘটনায় মাদক আইনে একটি এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা হয়েছে।
মামলার এজাহারে নূর উদ্দিন জানিয়েছেন, ২২ জুলাই আশুলিয়া থানার কনস্টেবল মমিনুর রহমানের নেতৃত্বে তিন পুলিশ সদস্য রাত ১১টায় জামগড়া এলাকায় তার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মেসিতে এসে হুমকি দিয়ে যান। তারা এও বলে যান যে, তার দোকানে অবৈধ মালামাল রয়েছে। তাদের ওই অভিযোগের তিনি প্রতিবাদ করেন এবং তার ফার্মেসি তল্লাশি চালিয়ে দেখতে বলেন। কনস্টেবল মমিনুর ও তার দুই সহযোগী ভিতরে ঢুকে তার কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা দিতে রাজি না হলে অল্প কিছু সময় পরই এসআই সাজ্জাদুর সেখানে আসেন। ঘুরেফিরে দেখেন এবং তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারে দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। এর পরই মমিনুর তাকে ভয় দেখান, আর বলেন, ‘টাকা দিবি, না দিলে ক্রসফায়ার।’ এরপর নূর উদ্দিন ভয় পেয়ে ক্যাশ থেকে ৬৩ হাজার টাকা বের করে দেন। এ টাকা নিয়ে মমিনুর বলেন, ‘দুই দিন পর আসব, আরও ৫০ হাজার টাকা রেডি রাখবি।’
এরপর ২৬ জুলাই তার মোবাইল ফোনে একটি কল আসে। ফোনে তাকে বলা হয়, ঢাকার মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয় থেকে বলছি। সন্ধ্যার পর যে কোনো সময় তারা তার ফার্মেসিতে আসবে এবং তাকে বাকি টাকা রেডি রাখতে বলে। এ পরিস্থিতিতে নূর উদ্দিন র্যাব-৪-এর সিপিসি-২ নবীনগর ক্যাম্পে অভিযোগ করেন। এ অভিযোগে র্যাব সদস্যরা তার ফার্মেসির আশপাশে অবস্থান নেন। আর যখন ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ছয়-সাত জনের একটি দল মাইক্রোবাসে করে তার ফার্মেসিতে টাকা নিতে আসে, তখন তিনি কৌশলে সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। এরপর র্যাব সদস্যরা তাদের নোহা মাইক্রোবাসটি আটক করে। এ সময় পুলিশের একটি জ্যাকেট, একটি ওয়াকিটকি, কিছু ইয়াবা ট্যাবলেট এবং ফেনসিডিল জব্দ করা হয়। আটক করা হয় কনস্টেবল মমিনুর, সোর্স আবদুল হামিদ, ওয়াহেদ ও ওয়াজেদ শেখসহ চারজনকে। পরে তাদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করেন নূর উদ্দিন। এরপর র্যাব আরও তিনটি মামলা করে। এসব ঘটনায় এসআই সাজ্জাদুরকে ক্লোজ করে ঢাকা জেলা পুলিশ।
ব্যবসায়ী নূর উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে একদফা টাকা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট হয়নি। আবার টাকা নিতে আসবে বলে জানায়। বিষয়টি র্যাব-৪কে জানাই। পরে নির্ধারিত সময়ে আবারও টাকা নিতে এলে র্যাব সদস্যরা চারজনকে গ্রেফতার করে। তারপর আমি আশুলিয়া থানায় মামলা করি।
জানা গেছে, এই চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে আশুলিয়া এবং আশপাশের এলাকার ব্যবসায়ী ও নিরীহ ব্যক্তিদের টার্গেট করত। তারপর অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করত। বিভিন্ন সময় নিরীহ ব্যক্তিদের মাদক দিয় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা নিত। মাদক ও জালনোটের ব্যবসার সঙ্গেও তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই চক্রে পুলিশের একাধিক সোর্সও রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সিভিল পোশাকে এবং রাতে এ ধরনের অপকর্ম করতেন।
এদিকে দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহহিল কাফী গণমাধ্যমকে বলেন, এসআই সাজ্জাদুর ও কনস্টেবল মমিনুরকে সাময়িক বরখাস্তের পাশাপাশি বিভাগীয় মামলা হয়েছে। মামলা এখনো চলমান।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব-৪ এর স্পেশাল কোম্পানির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জমির উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ না হলে এ বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু পুলিশ সদস্য মিলে আইনের অপব্যবহার করে ডাকাতি করার নিমিত্তেই এই চক্রটি গড়ে তোলেন। একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চেয়ে কম নয় এই চক্রটি। আইনকে ব্যবহার করে তাদের চাঁদাবাজি ও নানা অপকর্ম একদিকে যেমন পুলিশের জন্য লজ্জার অপরদিকে দেশের জন্যও। সাম্প্রতিককালে পুলিশের এহেন অপকর্মের অভিযোগ সন্ত্রাসীদের চেয়েও বেশি পরিমাণে আসছে। পুলিশের কাছে অনেকটাই জিম্মি হয়ে আছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, কর্মজীবীরা। কিছু হলেই সন্ত্রাসীদের চেয়ে ভয়ানক পদ্ধতিতে নির্যাতন করা হয়। যখন তখন ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে লুটে যাচ্ছে প্রচুর টাকা। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/ডিজে/কেএইচ/১২৫৬
আপনার মতামত জানানঃ