কবির হোসেন : ১৯৮২ সালে বৌদ্ধ প্রধান মিয়ানমারে নাগরিকত্ব নিয়ে একটি আইন পাশ হয়৷ আর তাতেই নাগরিকত্ব হারায় মুসলিম প্রধান রোহিঙ্গারা৷ জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হন৷ কিন্তু এতে এটা দাঁড়ায় না যে, বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের দায় নিতে হবে কেবলি বাংলাদেশের। আইন করে নিজ দেশের জনগণকে বাস্তুচ্যুত করার দায়ে মিয়ানমারকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর কথা। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির এমনি এক চাল, যেখানে জোট বেঁধে বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশই মৌন ব্রত পালন করছেন। তবুও, কথার খাতিরে, রোহিঙ্গাদের আইনত যেহেতু কোনো দেশ নেই, এর দায় পড়ে গোটা পৃথিবীর কাঁধেই। এতদসত্বেও, প্রতিবেশি দেশ হিসাবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের প্রতি অনেক মানবিক আচরণ করেছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে মানবিক বাংলাদেশ৷ জনসংখ্যার চাপে থাকা ছোট্ট দেশটিতে এখন প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে৷
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে সাত লাখ রোহিঙ্গারা বাধ্য হয়ে পাড়ি জমায় বাংলাদেশে। এর আগেও, বহু বছর ধরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন অব্যাহত ছিল। ২০১৭ সালেই রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় ঢেউটি আসে বাংলাদেশে। অবশ্য এই আসা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল হিসাবে বিশ্ব মোড়লেরা কেন বারেবারে বাংলাদেশের দিকেই আঙ্গুল তুলে আসছে? বিভিন্ন দেশের কিছু কিছু বক্তব্য রোহিঙ্গাদের গ্রহণ বিষয়ে বাংলাদেশের ঔচিত্য বলেও প্রকাশ করে। অথচ আন্তর্জাতিক কোনো আইনেই বাংলাদেশের ওপর এর কোনো দায় তারা দিতে পারে না। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া সংক্রান্ত যেকোনো পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশের নামটি তাদের জিভের গোড়ায় চট করে চলে আসে। যেন মিয়ানমার নয়, রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করার পেছনে বাংলাদেশ জড়িত এবং রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থী ভর্তি একটি নৌযান ভারতীয় জলসীমা আন্দামান সাগরে আটকা পড়ে। তাদের কাছে থাকা খাবার ও পানি ফুরিয়ে যায়। ইতোমধ্যে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন, তাই দ্রুততম সময়ে উদ্ধার করার জন্য আহ্বান জানান জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাটি ইউএনএইচসিআর। সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে ভারত। ভারতীয় কোস্ট গার্ডের দুইটি জাহাজ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। কেননা, নৌযানটি অন্যান্যদেশের তুলনায় ভারতের সবচেয়ে নিকটে মাত্র ১৪৭ কিলোমিটার দূরে ছিল, যেখানে বাংলাদেশের দূরত্ব ছিল ১৭০০ কিলোমিটার। তবে ভারতের জলসীমায় আটকা পড়া রোহিঙ্গাদের ভারত উদ্ধার করে নিয়ে এলেও এখন তাদের বাংলাদেশে পাঠাতে চায়। ভারত স্পষ্ট করে জানায়, ভারত ওই রোহিঙ্গাদের দেশে রাখতে চায় না। বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়। ভারত দাবি করছে, নৌকার ৪৭ জন যাত্রীর কাছে ইউনাইটেড নেশন, হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস(ইউএনএইচসিআর)-এর পরিচয়পত্র ছিল। তাতে লেখা, তারা মিয়ানমার থেকে ছিন্নমূল হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
অথচ বাংলাদেশ গত সোমবার জানায়, কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো নৌকা ছেড়েছে, এমন খবর সরকারের কাছে নেই। এখন কথা হলো, এই রোহিঙ্গাদের দায়ভার কেন বাংলাদেশ নেবে? কেনইবা নিতে হবে?
এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, সাগরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আটকে পড়া নৌযানটি বাংলাদেশের জলসীমা থেকে অনেক দূরে রয়েছে। গতকাল ২৫ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে বিবৃতি দেয় মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, ‘নৌযানটির অবস্থান বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক ১৭০০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। যা মিয়ানমার থেকে আনুমানিক ৪৯২ কিলোমিটার, থাইল্যান্ড থেকে ৩৬৩ কিলোমিটার, ইন্দোনেশিয়া থেকে ২৮১ কিলোমিটার ও ভারত থেকে ১৪৭ কিলোমিটার দূরে।’
আরও বলা হয়, ‘এর আগে সমুদ্রে ভাসমান রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে আশপাশের অন্যান্য দেশ অস্বীকৃতি জানালেও বাংলাদেশ সরকারই এসব লোককে উদ্ধারে এগিয়ে আসে। ঢাকা মনে করে, আটকে পড়া নৌযানটি যে দেশের জলসীমায় ভাসছে সেই দেশের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে এটিকে উদ্ধার করা। তাদের উচিত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ব-বহনের নীতি পালন করা।’
এর আগেও বিভিন্ন কিস্তিতে সাগরে ভাসমান অসংখ্য রোহিঙ্গাদের মানবিক খাতিরে বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে। যদিও সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গাবাহী নৌকাগুলো বাংলাদেশের জলসীমার বাইরেই ভাসছিল। নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের দল মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলে মালয়েশিয়া থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে পরে সাগরে ভাসতে থাকে। আর এসব নৌকার অধিকাংশই বাংলাদেশ জলসীমার বাইরেই ভাসতে থাকে। কিন্তু এসব ভাসমান রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘসহ প্রায় সমস্ত মোড়লদেরই অনুরোধ আসে। ইতিমধ্যে অনুরোধের এমন অনেক ঢেঁকিই বাংলাদেশ গিলেছে। সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা দেখলেই তাদের উতরানো দরদ এসে ঠেকে বাংলাদেশে। এমনভাবে অনুরোধ করা হয় যেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের নাগরিক ছিল এবং বাংলাদেশ তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সাগরে ভাসতে দেখলেই কেনো সকলের মুখে বাংলাদেশের নাম প্রথমে আসে?
এর আগে সাগরে ভাসমান ৫০০ রোহিঙ্গা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের নিকট অনুরোধ আসে। তখন বাংলাদেশ তাদের দায় নিবে না মর্মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন জানান, দুটি নৌকায় প্রায় পাঁচ শ রোহিঙ্গা বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানে ভাসছে। মালয়েশিয়া সরকার তাদের নেয়নি। ফলে এখন তারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। এদের গ্রহণ করার কোনো দায়বদ্ধতা বাংলাদেশের নেই। তার মতে, তাদের সাহায্যের জন্য অন্য দেশও এগিয়ে আসতে পারে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, এ অঞ্চলে অনেক দেশ আছে, শুধু বাংলাদেশের কাছে এদের নেওয়ার অনুরোধ আসে কেন?
কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী দায় নিতে অস্বীকৃতি জানালেও বাংলাদেশ অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে গিলতে এখন গলা অবধি পৌঁছে গেছে। তবুও সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা দেখলেই বাংলাদেশের জনগণ মনে করা হয়, আর তাদের চাপিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় জাতিসংঘসহ অন্যান্যরা। কেবল অনুরোধ নয়, বিভিন্ন অজুহাতে আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কেউ যদি গভীর সমুদ্রে থাকে তাহলে তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব হচ্ছে গভীর সমুদ্রের আশপাশের দেশগুলোর। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের এই এলাকায় যেসব দেশ আছে—থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত কিংবা ফিলিপিন্স তাদের কাছে কেউ গিয়ে অনুরোধ করে না রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। অথচ রোহিঙ্গাদের বহনকারী নৌকাগুলো বাংলাদেশের জলসীমায় নয়, বরং এরা অবস্থান করছে গভীর সমুদ্রে, অন্যান্যদেশের সন্নিকটে, তবুও জাতিসংঘসহ প্রায় সকলেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে গছানোর জন্য বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। রোহিঙ্গা বিষয়ে কেনো বাংলাদেশের নামটি এতো ওতপ্রোতভাবে প্রোথিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে? বা, কেন রোহিঙ্গাদের গ্রহণ কিংবা আশ্রয়স্থল হিসাবে বাংলাদেশকে বাধ্যতামূলক ভাবা হচ্ছে? রোহিঙ্গাদের দায় কি কেবলি বাংলাদেশের, আর কোনো দেশের কথা কেন মাথায় আসে না তাদের?
এসডব্লিউ/১৯৫২
আপনার মতামত জানানঃ