সংবাদ প্রকাশের বিনিময়ে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোকে অর্থ দেওয়ার বিধান রেখে গুগল-ফেসবুকের জন্য আইন পাস করেছে অস্ট্রেলিয়া। কয়েকদিন ধরে চলা জল্পনা-কল্পনা শেষে গুগল ও ফেসবুকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে এ আইন পাস করেছে অস্ট্রেলিয়া। আজ বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট আইনটি পাস হয়। নতুন এই আইনের কারণে গুগল-ফেসবুক তাদের প্ল্যাটফর্মে অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় নিউজ কন্টেন্ট প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট সংবাদ মাধ্যমকে অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে। অর্থাৎ, এখন থেকে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোকে বেশ আকর্ষণীয় পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে গুগল ও ফেসবুককে। এদিকে একই আইন অনুসরণ করার কথা ভাবছে যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশ। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাদের প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
অস্ট্রেলীয় পার্লামেন্টে এই আইনের প্রস্তাবনার সময় থেকেই তা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিল গুগল-ফেসবুকের মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলো। এমনকি, গত বৃহস্পতিবার থেকে অস্ট্রেলিয়ায় স্থানীয় সংবাদ পরিবেশনও বন্ধ করে দিয়েছিল ফেসবুক। ওই প্রস্তাবিত বিলের বিরুদ্ধেই যে এই পদক্ষেপ, সে সময় তা-ও জানানো হয়েছিল সংস্থার পক্ষ থেকে। যদিও মঙ্গলবার থেকে ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ফেসবুক।
নয়া আইন নিয়ে শুরু থেকে সরব হয়েছিল গুগলও। তবে ওই বহুজাতিকদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার অতি সহজেই ওই আইন পার্লামেন্টে পাস হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে বিশ্বজুড়েই একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল অস্ট্রেলিয়ার স্কট মরিসন সরকার।
অস্ট্রেলিয়া সরকার বলছে, নিউজ মিডিয়া অ্যান্ড ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মস ম্যান্ডাটরি বার্গেনিং কোড নামের এই আইন সংবাদ ব্যবসার জন্য ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করবে। আইনটি অস্ট্রেলিয়ায় জনস্বার্থ কেন্দ্রিক সাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবে।
তবে, নতুন আইনের অধীনে নিউজ কন্টেন্ট প্রকাশের জন্য অর্থ পরিশোধের বিষয়ে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর দর কষাকষির সুযোগ থাকছে। আলোচনা ব্যর্থ হলে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন সালিশে নেওয়ার সুযোগও থাকবে। এখন থেকে, গুগলের শোকেসে যেসব নিউজ কন্টেন্ট প্রদর্শিত হবে, তার জন্য অর্থ পরিশোধ করতে হবে। ফেসবুকের নিউজ ফিডে যেসব সংবাদ মাধ্যমের খবর থাকবে, তাদেরকেও অর্থ পরিশোধ করবে ফেসবুক।
অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এসিসিসি জানিয়েছে, আইন প্রণয়নের আগ পর্যন্ত গুগল ও ফেসবুকের মতো টেক জায়ান্টদের ওপর একচেটিয়া নির্ভরতার কারণে সংবাদমাধ্যমগুলোর দর কষাকষির সুযোগ ছিলো না। সংবাদের দাম নিয়ে কোনও বিরোধ তৈরি হলে তার সমাধান দিতে পারবে শালিসকারীরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে লাভবান হবে সংবাদমাধ্যম।
ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমগুলি ভালো কনটেন্ট তৈরি করেও বিজ্ঞাপন পায় না। বেশ কিছুদিন ধরেই এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বে আলোচনা হচ্ছে। যে মডেলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি চলে তা নিয়েও বহু কথা হচ্ছে। দেখা যায়, ডিজিটাল মিডিয়ার ভালো কনটেন্ট থেকে গুগল, ফেসবুক রোজগার করছে। কারণ, তারা বিজ্ঞাপন পাচ্ছে। অথচ সেই কনটেন্টের জন্য সংবাদমাধ্যমের পেজটিতে কেউ বিজ্ঞাপন দিচ্ছে না।
অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রক সংস্থার দাবি, নিজেদের পাতায় স্থানীয় সংবাদ পরিবেশন করে তারা অনলাইনে বিজ্ঞাপন বাবদ লাখ লাখ অর্থ আয় করলেও সেই লভ্যাংশ পায় না দেশের প্রকাশকেরা। অথচ, বিজ্ঞাপন থেকে অস্ট্রেলীয় সংবাদ প্রকাশকদের আয় কমছে। অর্থাৎ, যারা ওই সংবাদ আসলে প্রকাশ করছে, তারা সেই সংবাদ থেকে অর্থ পাচ্ছে না। অথচ সেই সংবাদ নেটমাধ্যমে ফেসবুক বা গুগল তুলে দিয়ে মুনাফা করছে।
এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতেই নয়া আইন করা হয়েছে বলে দাবি অস্ট্রেলীয় সরকারের। যদিও মরিসন সরকার-ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম তথা রুপার্ড মার্ডক সাম্রাজ্যকে সুবিধা দেয়ার জন্যই এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন সমালোচকদের একাংশ। তবে অস্ট্রেলিয়ার নতুন আইন সেই সমস্যা অনেকটাই দূর করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। একই সঙ্গে ফেক বা ভূয়া নিউজের উপরেও এর ফলে নিয়ন্ত্রণ আসবে বলে অনেকের ধারণা।
তবে ইতিমধ্যেই গুগল স্থানীয় মিডিয়া কোম্পানিগুলোর সঙ্গে লাখো ডলারের চুক্তি করেছে। ফেসবুকও অস্ট্রেলিয়ার একটি গণমাধ্যম কোম্পানির সঙ্গে প্রস্তাবিত চুক্তির বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছে। ফেসবুক ও গুগল জানিয়েছে, আগামী তিন বছরে তারা পৃথকভাবে সারা বিশ্বে সংবাদ খাতে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার করে বিনিয়োগ করবে।
এদিকে একই আইন করার জন্য ভাবছে যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশ। বলা হচ্ছে, কতগুলো দেশ একে জাতীয় আইন করা যায় কিনা বিবেচনা করে অস্ট্রেলিয়ার বিষয়টি ব্যাপকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে গণমাধ্যমগুলোও বিষয়টি গভীর নজরে রেখেছে। ভারত, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধানেরা অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তাবিত আইনে ফেসবুকের প্রতিক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
এদিকে কানাডার ঐতিহ্যমন্ত্রী স্টিভেন গিলবো গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, তার দেশ আসন্ন মাসগুলোতে অস্ট্রেলিয়ার পথ অনুসরণ করবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাংবাদিকতা টিকিয়ে রাখতে হলে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ পরিশোধের ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে ফেসবুককে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ