বরিশাল শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেনের চাকরি মেয়াদ আগামী মার্চ মাসে শেষ হবে। এতে তিনি তড়িঘড়ি করে বেআইনিভাবে পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার পাঁয়তারায় লিপ্ত হন বলে অভিযোগ। হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি শর্ত লঙ্ঘন করে নিজ জেলার প্রার্থীদের ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। সূত্র মতে, যবাবার আগে ‘আখেরী বানিজ্য’ করার জন্য তিনি তড়িঘড়ি করে বেআইনিভাবে পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন।
ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বাণিজ্য হচ্ছে অভিযোগ করে তা স্থগিত চেয়ে গতকাল বুধবার বরিশাল সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা হয়েছে। মামলা করেন ওই নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ দুই চাকরিপ্রত্যাশী সিরাজুল ইসলাম ও জুয়েনা নীতি। মামলা সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলার বাসিন্দা ওই দুই প্রার্থী শেবাচিম হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট পদে আবেদন করেছিলেন। গত শনিবার অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন তারা। তাদের অভিযোগ, পরিচালক তার পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে তাদের অনুত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে। তাদের পক্ষে মামলা করেন আইনজীবী আজাদ রহমান।
এর আগেও ২০১৫ সালে ১৭২ পদে নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করে ২১২ জনকে নিয়োগ দিতে গিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিলো তৎকালীন হাসপাতাল প্রশাসনের বিরুদ্ধে। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করলে নিয়োগপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। আর উচ্চ আদালতের রায়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা কাজেও যোগ দেন। এরপর বেশ কয়েকটা বছর কেটে যাওয়ার পরে ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে ১২টি ক্যাটাগরিতে ৩২ জন ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। আর তা নিয়েও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এরই প্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার বরিশাল সদর সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে পাবনা জেলার জাবরকোলের দুই পরীক্ষার্থী সিরাজুল ইসলাম ও জুয়েনা নীতি যৌথভাবে অভিযোগ দাখিল করেন।
আদালতের বিচারক রুবাইয়া আমেনা মামলাটির আদেশের পরবর্তী দিন ধার্য্য করেন। মামলায় অন্যান্য বিবাদীরা হলেন, শেবাচিম হাসপাতালের উপ-পরিচালক ও কর্মচারী নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বরিশাল জেলা প্রশাসক, বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক ও মেহেন্দিগঞ্জ উলানিয়ার আশা এলাকার আবুল কালাম, পটুয়াখালী বাউফল বিলবিলাস এলাকার আশ্রাফুজ্জামান ও ঝালকাঠী কাঠালিয়ার জোরখালী এলাকার মিজানুর রহমান।
মামলা পরিচালনাকারী আজাদ রহমান জানান, ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে ১২টি ক্যাটাগরিতে ৩২ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, মাদারীপুর ও বাগেরহাট জেলার প্রার্থীদের আবেদন না করার জন্য বলা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজুল ইসলাম ও জুয়েনা সব কাগজপত্র সংযুক্ত করে ফার্মাসিস্ট পদে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব হাসপাতালের উপ-পরিচালক তাদের প্রবেশপত্র ইস্যু করেন।
কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পরীক্ষার দিন কমিটির সদস্যরা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ পাইয়ে দিতে বাইরে থেকে নকল সরবরাহ করে। বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলা বাদে বাকি পাঁচ জেলার কোটা বাদ দিয়ে হাসপাতালে ১২টি ক্যাটাগরিতে ৩২ জন নিয়োগের কথা থাকলেও বরিশালের বাসিন্দা ও হাসপাতালে কর্মরত কর্মচারীরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তাদের স্বজনদের জন্য আবেদন করেন।
এদের মধ্যে মেহেন্দিগঞ্জ উলানিয়ার আশা এলাকার আবুল কালাম। তিনি বর্তমানে নগরীর রুপাতলী এলাকায় বসবাস করেন। আবুল কালাম সাবেক ও বর্তমান পরিচালকের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় দুই বছর আগে তার চাকরির বয়সসীমা পেরিয়ে গেলেও তিনি গাজীপুর জেলার ঠিকানা ব্যবহার করে চালক পদে আবেদন করেন।
একইভাবে হাসপাতালের অফিস সহকারী সৈয়দ নান্নার মেয়ে এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতির সভাপতি মোদাচ্ছের কবিরের মেয়েকে চাকরি পাইয়ে দিতে একই জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আবেদন করেন।
ওই তালিকায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও প্রধান সহকারীর নাম রয়েছে। কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়া পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে প্রবেশপত্র দেওয়া ও পরীক্ষার সময় বাইরে থেকে উত্তর সরবরাহ করেন।
আবুল কালাম শর্তানুসারে নিয়োগ পেতে অযোগ্য হলেও পরিচালকসহ অন্যদের সহায়তায় তিনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া পটুয়াখালীর আশ্রাফুজ্জামান ও ঝালকাঠির মিজানুর রহমান শর্তানুসারে অযোগ্য হলেও তারা ফার্মাসিস্ট পদের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। একই সঙ্গে ৬ ফেব্রুয়ারি পরিচালক ২৪ ঘণ্টায় ৪৪৪ প্রার্থীর পরীক্ষার ফল বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
পরিচালকের চাকরি মেয়াদ আগামী মার্চ মাসে শেষ হবে। এতে তিনি তড়িঘড়ি করে বেআইনিভাবে পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার পাঁয়তারায় লিপ্ত হন। এ ঘটনায় নিয়োগের সব কার্যক্রম বাতিল চেয়ে পুনরায় সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য মামলাটি করলে বিচারক আদেশের জন্য রেখে দেন। এ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেনের মোবাইলে কল করা হলে তিনি নিয়োগ প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মানুষ মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এমনকিছু করে যায় যেন তাকে পরবর্তীতে স্মরণীয় করে রাখা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে কিভাবে নিজের পকেট তাজা করে ফেরা যায়, এনিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা মনে করেন, শেষ মুহূর্তে এসে আখেরি বাণিজ্য দিয়েই বিচার করা যায় তিনি এতোদিন ধরে কী করে আসছেন। ধনাঢ্য হওয়ার জন্য পরিচালক প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। নিয়োগের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হস্তগত করার জন্যই তিনি এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। মানেননি কোনো নিয়ম, বিধি। নিয়োগে এমন অনিয়মের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত এবং হাসপালটিকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াসহ হাসপাতালে স্বাভাবিক পরিবেশ নিয়ে আসার আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৪
আপনার মতামত জানানঃ