প্রায় প্রতিদিনই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আসে। চিত্রটা এমন, যে যেভাবে সুযোগ পেয়েছে তার তার অবস্থান থেকে সেভাবেই অনিয়ম দুর্নীতি করেছে। অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ থেকে সরকারি কোনো দপ্তরই মুক্ত নয়। ঘুণপোকার মতো সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে দুর্নীতিবাজ। এসবের কয়েকটা আলোচনায় উঠে আসে, অধিকাংশই থাকে আড়ালে। দুদকের তদন্তেও যে দেশের সামগ্রিক চিত্রটা উঠে আসে তেমনও নয়। তবুও দুদক প্রায় প্রতিদিনই সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ এনে মামলা করে যাচ্ছে। দুদকের বাইরেও আদালতে অনেক মামলা আসে। গত রোববার অনিয়মের অভিযোগ এনে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এক ব্যক্তি। এদিকে দিনাজপুরে সরকারি দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে সরকারি কোষাগার থেকে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
দুই কর্মকর্তা হলেন-আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাশ সরকার আমিরুল ইসলাম (৩৪) ও দিনাজপুর জেলা একাউন্টস অফিসের অডিটর মাহাফুজুর রহমান (৪২)।
জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থ দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাশিয়ার আমিরুল ইসলাম ও জেলা হিসাব রক্ষণ অধিদপ্তরের অডিটর মাহফুজুর রহমান ২ জন যোগসাজশ করে আরও অন্যান্যদের সহযোগিতায় গত ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ভুয়া ভাউচার, বিল প্রস্তুত এবং ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে ভুয়া এনআইডি ব্যবহারে সেবিকা খাতের ২ কোটি ১৯ লক্ষ ৬৯ হাজার ৪২৮ টাকা আত্মসাৎ করে। বিষয়টি হিসাব অধিদপ্তর অবগত হয়ে দিনাজপুর জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাকে মামলা করার নির্দেশ দেয়।
জেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি রাতে কোতোয়ালী থানায় এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ও দুদক আইনে একইসঙ্গে দায়ের করা হয়। দুদকের আওতাভুক্ত মামলা হওয়ায় দুদক পুনরায় বাদী হয়ে এই ঘটনায় অপর একটি মামলা দায়ের করেন।
দিনাজপুর সমন্বিত আঞ্চলিক দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয় (দুদক) এর উপ-পরিচালক আবু হেনা মো. আশিকুর রহমান জানান, দুদকের সহকারী পরিচালক আহসানুল কবীর পলাশ বাদী হয়ে শনিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে তার কার্যালয়ে এ মামলাটি দায়ের করেছেন। মামলায় পুলিশের গ্রেপ্তারকৃত ২ আসামি দুদকের উপ-পরিচালক নিজে তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়ে তাদেরকে পুনরায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ২টায় দিনাজপুর জেলা ও দায়রা জজ আজিজ আহাম্মেদ ভূঞার আদালতে আবেদন করেছেন।
এদিকে পছন্দের ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাবুগঞ্জ সহকারী জজ আদালতে নগরীর বান্দ রোডের মেসার্স পিওর এন্টারপ্রাইজের মালিক মিজানুর রহমান রোববার মামলাটি করেন। বিচারক মো. আতিকুজ্জামান তা আমলে নিয়ে পরবর্তী দিন ধার্য করেন। মামলার অন্য বিবাদীরা হলেন-আরএমও, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এক মেডিকেল অফিসার, উপজেলা বন কর্মকর্তা, বরিশালের সিভিল সার্জন ও বাবুগঞ্জের বাহেরচর ইউনিয়নের ক্ষুদ্রকাঠী গ্রামের বাসিন্দা ঠিকাদার শফিকুর রহমান খান।
মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী আজাদ রহমান জানান, ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ২০২০-২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য পথ্য, মনিহারি ও বিবিধ সামগ্রী সরবরাহ এবং কাপড় ধোলাই করতে ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহ্বান করেন। ৩১ ডিসেম্বর ঠিকাদার মিজানুর রহমান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ে দরপত্র দাখিল করেন। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নিয়ম-বহির্ভূতভাবে দরপত্রসহ অন্য কাগজপত্র নিজের বাসায় রেখে দেন। সাধারণত দরপত্র দাখিলের পর এক সপ্তাহের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দরপত্র দাখিলের পর ২৮ দিন পার হলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
ঠিকাদার মিজানুর রহমান দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও তাকে কার্যাদেশ না দিয়ে কালক্ষেপণ করেন। অপরদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে ঠিকাদার শফিকুর রহমান খানের শর্তাবলীর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার পরও নিজ বাসায় বসে আগের তারিখে ফরম ফিলাপ করিয়ে ঠিকাদার মিজানুর রহমানকে দরপত্রের কার্যাদেশ দেওয়া থেকে বঞ্চিত করেন। প্রতিষ্ঠানের শর্তাবলী ভঙ্গ করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদার শফিকুর রহমান খানকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগে ২১ জানুয়ারি ঠিকাদার মিজানুর রহমান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়ে ৩ দিনের মধ্যে তাকে কার্যাদেশ বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ করেন। একইসঙ্গে তিনি বরিশালের সিভিল সার্জন বরাবর আপিল করেন। সিভিল সার্জন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। ২৭ জানুয়ারি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কোনো প্রকার কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে মিজানুর রহমানকে শুধুমাত্র মনিহারি ও বিবিধ মালামাল সরবরাহ এবং কাপড় ধোলাই কাজের ঠিকাদার নিয়োগ করেন। অন্যদিকে শফিকুর রহমান খানকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও পথ্য সরবরাহের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করেন। এ ঘটনায় রোববার মামলা করেন মিজানুর রহমান।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি দপ্তরগুলোও আমাদের সমাজের মতোই ঘুণেধরে আছে। সমাজে সরকারি চাকরি নিয়ে প্রচলিত যেসব ধারণা রয়েছে অর্থাৎ সরকারি চাকরি করলে উপরি আয়ের ব্যবস্থা ভালো, আর এই মতেই অভিভাবকরা উঠেপড়ে লেগে যান সন্তানকে সরকারি অফিসার বানাতে, এটা সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতি বিনির্মাণে যেমন বিপজ্জনক তেমনি নৈতিক দিক দিয়ে বেড়ে ওঠাও অনেক চ্যালেঞ্জের। ফলে বিভিন্ন সেক্টরে অনিয়ম আর দুর্নীতির মতো অভিযোগ উঠে আসে। শুধু মামলা মোকদ্দমা করেই দুর্নীতি থেকে পার নয়, সমাজের রন্ধ্রে সরকারি চাকরি নিয়ে যে ধারণা বিষের মতো ছড়িয়ে আছে এটাও নির্মূলে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। নয়তো প্রজন্ম পর প্রজন্ম সরকারি দপ্ততগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০২
আপনার মতামত জানানঃ