আমাদের মহাবিশ্ব বিশাল। আপনার কল্পনার চেয়ে বিপুল তার আয়তন। অন্য গ্রহ-নক্ষত্র কিংবা ছায়াপথের কথা বাদই দিলাম, আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশি চাঁদের দূরত্বও পৃথিবী থেকে অনেক—গড়ে প্রায় ৩ লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। পায়ে হেঁটে এই পথ পাড়ি দিতে লাগবে কমসে কম ৯ বছর। আর সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানে চড়ে গেলে লাগবে প্রায় ১৮ দিন (অবশ্য পায়ে হেঁটে কিংবা যাত্রীবাহী বিমানে চাঁদে পৌঁছানো সম্ভব নয়)। আধুনিক স্পেস শাটলে লাগবে প্রায় ১৪ ঘন্টা। সে তুলনায় পৃথিবী থেকে চাঁদে আলো পৌঁছায় প্রায় চোখের পলকে—মাত্র ১.৩ সেকেন্ডে।
বিজ্ঞানীদের হিসেবে আলোর গতিই মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতি। এর গতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার বা ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল। তাই এই গতি অর্জন করা সম্ভব হলে মাত্র এক সেকেন্ডে পৃথিবীর চারপাশে প্রায় সাড়ে ৭ বার পাক খেয়ে আসা যায়। পৃথিবী থেকে সূর্যে যাওয়া যাবে মাত্র সাড়ে ৮ মিনিটে। তবে আমাদের সবচেয়ে কাছে নক্ষত্র আলফা সেন্টুরাইয়ে যেতে চাইলে বাক্সপ্যাটরা ভালোভাবে গুছিয়ে নেওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ সেখানে যেতে কিছুটা বেশি সময়ই লাগবে। এ নক্ষত্রের দূরত্ব প্রায় ৪.৩৭ আলোকর্ষ। তাই আলোর গতিতে সেখানে যেতে লাগবে প্রায় ৪ বছর ৩ মাস।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনির লেখকরা সাধারণত এই প্রক্রিয়াতেই তাঁদের গল্পের নায়ককে এভাবে আন্তনাক্ষত্রিক ভ্রমণে পাঠান। প্রায় চোখের পলকে ওই নায়করা এক নক্ষত্র থেকে আরেক নক্ষত্রে পৌঁছে যান।
আর আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্যসব নক্ষত্রে যেতে লাগবে আরও অনেক বেশি সময়। তাই যাদের ইন্টারগ্যালাকটিক ভ্রমণের শখ, মানে অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে ঘুরে বেড়াতে চান, তাদের জন্য গোটা জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে নভোযানে ক্লান্তিরকর যাত্রায়। কারণ কী জানেন?
এই যেমন, আমাদের মিল্কিওয়ের গ্যালাক্সির কথাই ধরুন। এই ছায়াপথটার ব্যাস প্রায় ২ লাখ আলোকবর্ষ, সেটা এত বড় যে এর প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আলোর যেতে সময় লাগে প্রায় ২ লাখ বছর। (আলো এক বছরে যতটুকু দূরত্ব পাড়ি দেয়, সেটাই এক আলোকবর্ষ। সেই হিসেবে আলো এক আলোকবর্ষে পাড়ি দেয় প্রায় ৯.৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার বা ৫.৯ ট্রিলিয়ন মাইল।) আর আমাদের প্রতিবেশি গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রোমিডা? পৃথিবী থেকে প্রায় ২৫ লাখ আলোকবর্ষ দূরে। মানে আলোর গতিতেও সেখানে পৌঁছাতে লাগবে ২৫ লাখ বছর।
কাজেই বুঝতেই পারছেন, আলোর গতিতে চললেও আমাদের ছায়াপথটাই ঘুরে ফিরে দেখা সম্ভব নয়। সেখানে গোটা মহাবিশ্বের কথা ভাবাই অসম্ভব। এ সমস্যার সহজ সমাধান হলো, আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চলা। তাহলে হয়তো একটা মানুষ তার জীবদ্দশাতেই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বিভিন্ন নক্ষত্রে ঘুরে-ফিরে হেসে-খেলে বেড়াতে পারবে। চাই কি, প্রতিবেশি অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি কিংবা অন্য গ্যালাক্সিতেও ঢু মারা যাবে অনায়াসে। এভাবে গোটা মহাবিশ্ব অনুসন্ধান করা সম্ভব একজন মানুষের স্বাভাবিক আয়ুর মধ্যেই। ওই যে বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশন গল্প কিংবা মুভিতে যেমন দেখা যায়।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনির লেখকরা সাধারণত এই প্রক্রিয়াতেই তাঁদের গল্পের নায়ককে এভাবে আন্তনাক্ষত্রিক ভ্রমণে পাঠান। প্রায় চোখের পলকে ওই নায়করা এক নক্ষত্র থেকে আরেক নক্ষত্রে পৌঁছে যান। আলোর চেয়ে বেশি গতির নভোযান ছাড়াও এই লেখকরা ওয়ার্মহোল, টেলিপোর্টেশনের মতো কাল্পনিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেন। কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় কি সেটা করা সম্ভব?
পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইনকে দোষ দিতে পারেন। কারণ আমাদের আলোর বেগে চলার ইচ্ছার কফিনে পেরেকটা ঠুকেছেন তিনিই। ১৯০৫ সালে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেন তিনি।
যারা গাড়ি চালান তাঁরা হয়তো ভাববেন, অ্যাক্সিলারেটরে পা চেপে যেমন একটা গাড়ির গতি ক্রমেই বাড়িয়ে নেওয়া যায়, তেমনি একটা নভোযানের গতি বাড়িয়ে নিলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়। এভাবে নভোযানটির গতি বাড়াতে বাড়াতে একসময় আলোর গতিতে পৌঁছানো এবং তারপর আরও গতি বাড়িয়ে আলোর গতি ছাড়িয়ে যাওয়া তো জলভাতের মতোই সহজ!
কিন্তু এই জায়গায় এসে বাদ সাধেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। মানুষের বহুদিনের এই আন্তনাক্ষত্রিক স্বপ্নে স্রেফ জল ঢেলে দেন। তাঁরা বলেন, মানুষের পক্ষে আলোর চেয়ে বেশি কথা তো দূরের কথা, কোনোভাবেই আলোর গতি অর্জন করাই সম্ভব নয়। কী আশ্চর্য!
এর জন্য পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইনকে দোষ দিতে পারেন। কারণ আমাদের আলোর বেগে চলার ইচ্ছার কফিনে পেরেকটা ঠুকেছেন তিনিই। ১৯০৫ সালে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেন তিনি। হৈ চৈ ফেলা সে তত্ত্বের সার কথা হলো, মহাবিশ্বের কোনো কিছুই আলোর গতিতে চলতে পারবে না। আলোর গতিই মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিসীমা—বা মহাজাগতিক গতিসীমা।
একটা নভোযানের জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল শক্তি বা জ্বালানি। আর আমাদের প্রচলিত জ্বালানির কথা বিবেচনা করলে, নভোযানে প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি বহন করতে হবে। এ যেন বারো হাত কাকুড়ার তেরো হাত বিচি।
বিশেষ আপেক্ষিকতা আরও বলে, শুধু মাত্র শূন্য ভরের কোনো কিছুই আলোর গতিতে চলতে পারবে। যেমন ফোটন বা আলোর কণা। আর মানুষসহ নভোযানকে অবশ্যই আলোর চেয়ে অনেক কম বেগে চলতে হবে। কারণ আলো ছাড়া অন্য সব কিছুরই ভর আছে। এটাই পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম।
এর উত্তরের পাওয়া যায় বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কাছে। এ তত্ত্ব বলে, কোনো বস্তু যত আলোর গতির কাছাকাছি পৌঁছাতে থাকে, তার ভর ততই বাড়তে থাকে। বস্তুটি যত দ্রুত চলতে থাকবে, তার ভরও তত বেশি বাড়বে। এভাবে একসময় বস্তুটির ভর হয়ে যায় অসীম।
আবার এ কারণে সেই বস্তুটির গতি আরও বাড়ানোর জন্য ক্রমেই শক্তির পরিমাণও বাড়াতে হবে। আর একটা নভোযানের জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল শক্তি বা জ্বালানি। আর আমাদের প্রচলিত জ্বালানির কথা বিবেচনা করলে, নভোযানে প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি বহন করতে হবে। এ যেন বারো হাত কাকুড়ার তেরো হাত বিচি। তাতে নভোযানটাও এক পর্যায়ে অনেক ভারী হয়ে উঠবে। ফলে একসময় তার গতি বাড়ানোও কঠিন হবে। কাজেই তাত্ত্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, কোনো বস্তুকে আলোর গতি দিতে অসীম পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন। কারণ বস্তুটি তখন নিজেই অসীম ভরে পরিণত হয়।
আসলে নভোযানের গতির ক্ষেত্রে একটি সীমাবদ্ধতার রেখা টেনে দেয় আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে পাওয়া বিখ্যাত E=mc2 সমীকরণ (এখানে E হলো শক্তি, m হলো ভর এবং c হলো আলোর গতি)। এই সূত্র মতে, বস্তুর ভর ও শক্তি হলো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এদের একটাকে আরেকটায় রূপান্তর করা সম্ভব। কোনো বস্তু ত্বরণপ্রাপ্ত হলে তার মোট শক্তি বাড়ে বটে, তবে বস্তুটি যখন আপেক্ষিক গতি পায় তখন বিস্ময়কর একটা ঘটনা ঘটে। তখন দেখা যায়, এই শক্তি বস্তুর গতি না বাড়িয়ে তার ভর বাড়িয়ে দেয়। অন্য কথায়, কোনো বস্তু যত দ্রুত বেগে চলবে, তার ভরও তত বেশি হবে। যেমন একটা বস্তু যদি আলোর ১০ ভাগ গতিতে চলে, তাহলে তার ভর বাড়বে সাধারণ অবস্থার চেয়ে মাত্র ০.৫ ভাগ। কিন্তু বস্তুটি আলোর ৯০ ভাগ বেগে চললে তাঁর ভর বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আর বস্তুটি যতই আলোর গতির সমান হয়ে গেলে তার ভর হয়ে যাবে অসীম। তাই তার জন্য শক্তিও লাগবে অসীম পরিমাণ। এ কারণে সাধারণ বস্তু কখনই আলোর বেগে চলতে পারবে না।
একটা নভোযানের জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল শক্তি বা জ্বালানি। আর আমাদের প্রচলিত জ্বালানির কথা বিবেচনা করলে, নভোযানে প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি বহন করতে হবে। এ যেন বারো হাত কাকুড়ার তেরো হাত বিচি।
আবার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মতে, স্থান ও কাল আলাদা কিছু নয়, বরং এরা পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই পদার্থবিদরা একে এদের একক অস্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করেন—স্থানকাল বা স্পেসটাইম। পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন, আলোর বেগে চলা মানে শুধু স্থানের ভেতরে গতি নয়, বরং স্থানকালের ভেতরের গতি। এর ফলে আমাদের ‘কজ অ্যান্ড এফেক্ট’ বা কার্যকারণ সম্পর্ক এলোমেলো হয়ে যায়। তাতে কোনো কাজের আগেই তার প্রভাব দেখা যেতে পারে। এভাবে কার্যকারণ সম্পর্কে বেশকিছু প্যারাডক্সের সৃষ্টি হয়। বিষয়গুলো এককথায় উদ্ভট।
তবে এসব ঝামেলা এড়াতে কিছু বিজ্ঞানী নতুন কিছু আইডিয়া আমদানি করেছেন। যেমন ওয়ার্মহোল, র্যাপড্রাইভ। তাঁদের দাবি, এর মাধ্যমে তাত্ত্বিক এসব বাধা ডিঙানো সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, ওই দাবি পর্যন্তই। এদের কোনোটাই সম্ভব বলে বাস্তবে এখনও প্রমাণ করা যায়নি। তবে ভবিষ্যতের কথা এখনও বলা যায় না। হয়তো একদিন দারুণ এক চমক নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হবে পুরোপুরি নতুন কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং নতুন প্রযুক্তি। এসবের কাঁধে ভর দিয়ে তখন হয়তো সাইফাই লেখকদের কল্পনাগুলো ধরা দেবে বাস্তবে।
আপনার মতামত জানানঃ