রাজনীতিকে আলাদীনের চেরাগ বানিয়েছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান লাক মিয়া। নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের (আড়াইহাজার) সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সুতার বাজারের সিন্ডিকেট, মানি লন্ডারিং, জোর করে জমি দখল, মাদক কারবারসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যাতে নাম জড়ায়নি লাক মিয়ার। এসবের বদৌলতে মাত্র দেড় যুগে বনে গেছেন ১০ হাজার কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এমপি নজরুল ইসলাম বাবু তাঁর অবৈধ পথে উপার্জিত হাজার কোটি টাকা লাক মিয়ার ব্যাবসায়িক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার করেছেন। একসময়ের দিনমজুর বাবার ছেলে লাক মিয়ার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ায় বিস্মিত আড়াইহাজারের সাধারণ মানুষ। তারা লাক মিয়ার অবৈধ পথে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত লাক মিয়া ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। নজরুল ইসলাম বাবুর প্রভাব খাটিয়ে লাক মিয়া হয়ে ওঠেন আড়াইহাজারের গডফাদার। গঠন করেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। এমপি বাবুর দুর্নীতির টাকা বিনিয়োগে নিরীহ মানুষের জমি দখল করে একের পর এক গড়ে তোলেন শিল্প-কারখানা। মাত্র দেড় যুগে গড়ে তোলেন স্পিনিং মিল, ফিসারিজ, জমির ব্যবসা, মার্কেটসহ কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ লাক মিয়া ও তাঁর পরিবারের লোকজনের নামে।
আড়াইহাজার-ভুলতা আঞ্চলিক মহাসড়কের বিনাইচর গ্রামে চেয়ারম্যান লাক মিয়ার শিল্প-কারখানা ‘ভাই ভাই স্পিনিং মিলস লিমিটেড’। সড়কের দুই পাশে একে এক গড়ে তোলা হয়েছে জামান স্পিনিং মিলস লিমিটেড, লতিফা স্পিনিং মিলস লিমিটেড ও সাবেদ আলী স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ১০টি ইউনিট। কারখানাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় চার লাখ স্পেন্ডেল। পোশাকশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, স্পিনিং মিলগুলোর বাজারমূল্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
দুদকের অনুসন্ধানে মিলেছে লাক মিয়ার এক হাজার বিঘা জমির সন্ধান। যার বেশির ভাগ সরকারি সম্পত্তি বা জোর করে দখল করা অন্যের জমি। ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের মারোয়াদি, লস্করদী, মূলবান্দী, দিঘলদী, উজানগোবিন্দ, বিনাইচর, মনোহরদীসহ ১৪টি মৌজায় ৯১ একর ৫৯ শতাংশ এবং আড়াইহাজার পৌরসভার মধ্যে থাকা কামরাঙ্গীর চর, আড়াইহাজার ও ঝাউঘারা মৌজায় ১৭ একর ৯৬ শতাংশ ২১ অজুতাংশ জমির প্রমাণ ও তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া বাড্ডা, খিলক্ষেতসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্রায় দেড় শ কাঠা জমি রয়েছে তাঁর। পূর্বাচলেও লাক মিয়ার বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে। এ ছাড়া নরসিংদীতে রয়েছে তাঁর জমি। যার বাজার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা।
এসব জমি ছাড়াও লাক মিয়ার বিপুল পরিমাণ মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য পেয়েছে দুদক। নামে-বেনামে করা এসব প্রতিষ্ঠানের নামে গত ১৬ বছরে লাক মিয়া অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করেছেন। আর এসব টাকার কোনো তথ্য আয়কর নথিতে উল্লেখ করা হয়নি। এ পর্যন্ত লাক মিয়ার নামে ব্যাংক হিসাবের সন্ধান মিলেছে ৪৯টি। তাঁর স্ত্রীর নামে ১৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২৩০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা লেনদেনের সন্ধান মিলেছে।
আড়াইহাজার উপজেলার গোবিন্দি গ্রামে লাক মিয়ার পুরনো বাড়ি। ওই বাড়ির পাশেই ১৫ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন নতুন আলিশান বাড়ি। বাড়িটির নির্মাণকাজ চলছে আট বছর ধরে। ওই বাড়িতে রয়েছে অত্যাধুনিক সুইমিংপুল, ফোয়ারা এবং বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ। ভেতরে রয়েছে জলসা ঘরসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। দেশি-বিদেশি উপকরণে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়িটিতে বর্তমানে চলছে ফিনিশিংয়ের কাজ।
বাড়িটির নিরাপত্তাকর্মী হান্নান মিয়া জানান, স্যার তাঁর পছন্দ অনুযায়ী ধীরে ধীরে বাড়ির কাজ করছেন। আশা করছি, আর কয়েক মাসের মধ্যে বাড়ির সব কাজ সম্পন্ন হবে।
স্থানীয় টেক্সটাইল কারখানার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীরা জানান, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের সুতার বাজারের সিন্ডিকেটের প্রধান হলেন লাক মিয়া। তাঁর সিন্ডিকেটের কাছে টেক্সটাইল মালিকরা যেমন অসহায়, তেমনি স্পিনিং মিলের মালিকরাও জিম্মি। গত দেড় দশক ধরে সিন্ডিকেট করে সুতার দাম নিয়ন্ত্রণ করে একচেটিয়া মুনাফা করছেন লাক মিয়া। এর ফলে টেক্সটাইল মিল মালিকরা ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি অনেক স্পিনিং মিল রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। ভাড়ায় সেসব স্পিনিং মিলের কর্তৃত্ব নিয়ে সুতার মাফিয়ায় পরিণত হয়েছেন লাক মিয়া। নিজের প্রতিষ্ঠান সালমা ট্রেডার্সের মাধ্যমে একাই পরিচালনা করছেন কমবেশি ২৫টি স্পিনিং মিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপক বলেন, ‘লাক মিয়ার কাছ থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠান তুলা ক্রয় করত। চেকের মাধ্যমে সেই টাকা লেনদেন হতো। তাঁর সঙ্গে ব্যবসা নিয়ে মতবিরোধ হলে তিনি আমাদের বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার চেক ডিজঅনারের মামলা করেন। ওই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য দাবি করা এক কোটি টাকা রেজিস্ট্রি করে পরিশোধ করা হয়। কিন্তু আজও তিনি মামলা তুলে নেননি। উল্টো আমাদের হয়রানি করছেন। আমাদের মতো বহু ব্যবসায়ী লাক মিয়ার হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’
ছোট বিনাইচর গ্রামের কামাল মিয়া বলেন, ‘রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছেন লাক মিয়া। এমপি বাবুর ক্ষমতা তাঁকে আলাদীনের চেরাগ পাইয়ে দিয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন। এই টাকায় মানুষের রক্ত আর চোখের পানি লেগে আছে। আমরা তাঁর বিচার চাই।’
ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওসমান গনি বলেন, ‘আওয়ামী এমপি বাবুর ক্যাশিয়ার ছিলেন চেয়ারম্যান লাক মিয়া। এমপির অবৈধ টাকায় লাক মিয়ার ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। বনে যান হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। সেই টাকা ব্যবহার করে এমপি বাবু ও লাক মিয়া বিএনপি নেতা-কর্মীদের অত্যাচার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে ব্যবহার করেছেন। এসব অবৈধ টাকা উদ্ধার করে তাঁর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’
ভাই ভাই স্পিনিং মিলসের মহাব্যবস্থাপক লুত্ফর রহমান জানান, লাক মিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ১০টি স্পিনিং মিল রয়েছে। এ ছাড়া তিনি ভাড়ায় অন্তত ১৪টি স্পিনিং মিল পরিচালনা করেন। একই সঙ্গে তিনি তুলা ও সুতার ট্রেডিং ব্যবসা করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার কয়েক শ কোটি টাকা।
তবে এসব শিল্প-কারখানা নির্মাণে বিপুল টাকার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু শুনেছি তিনি ব্যবসা করেই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বড় শিল্প-কারখানা গড়তে অনেক জমির প্রয়োজন হয়। এতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।’
আপনার মতামত জানানঃ