‘আমার এই নম্বরে এক লাখ টাকা পাঠায়ে দেন’। ঘটনা হলো নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা বিএনপির সহযুব সম্পাদক বেলাল হোসেনের (সৌখিন) বিরুদ্ধে মামলার আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে এক আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে চাঁদা দাবি। এ বিষয়ে দুই নেতার কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
পাঁচ কোটি টাকার চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহের ‘সব কাজ না পাওয়ায়’ যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যশোর জেলা বিএনপির সদস্য এ কে শরফুদ্দৌলার নেতৃত্বে গত বৃহস্পতিবার তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে।
গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর হামলা, দখল, অর্থ দাবি, আধিপত্য বিস্তার, দলীয় নির্দেশনা অমান্য করাসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ১ হাজার ২৩ জন নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেটা ছিল দুই মাসের হিসাব, গত এক মাসে এসব ঘটনা যে আরও বেড়েছে, নওগাঁ ও যশোরের ঘটনাই তার প্রমাণ।
বিএনপির হাইকমান্ড শক্ত অবস্থান নিয়েও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের শামাল দিতে পারছেন না। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাঁরা বলেন, বিএনপি বিশাল দল, হাজার নেতাকর্মী; কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো ঘটবেই। কিন্তু অঘটনের সংখ্যা যখন হাজারের ওপরে চলে যায়, তখন আর সেটি বিচ্ছিন্ন থাকে না। সহজাত হয়ে যায়।
বিএনপি যে নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়া করছে দলীয় নেতা–কর্মীদের বেপরোয়া আচরণও তারও অন্যতম কারণ। দলের নেতৃত্ব মনে করছে, নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলে সব নেতা–কর্মী তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে দলে নিজের অবস্থান শক্ত করতে চাইবেন।
সরকারের ওপর তাদের যে নিয়ন্ত্রণ আছে, সেটা প্রমাণ করা। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ প্রশ্নে অনড় অবস্থান নিয়ে দলটি নিজের অবস্থান সংগত তরেছে। আওয়ামী লীগের পনের বছরে বিএনপির নেতা–কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি দমনপীড়নের শিকার হয়েছেন। মানুষের মন থেকে সেই স্মৃতি মুছে যাওয়ার আগে নির্বাচন হলে বিএনপি তার সুবিধা পাবে।
বিএনপি নেতৃত্ব মনে করে, কোনো কারণে আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচন করতে না পারে, তাদের সমর্থক ভোটারদের একাংশের সমর্থনও বিএনপি পাবে। ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপির নেতাদের বক্তৃতা–বিবৃতির প্রতি আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের সমর্থনকেও তারা ইতিবাচকভাবে দেখছেন।
ইতিহাসের পরিহাস হলো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আত্মগোপন অবস্থা বিএনপির নেতাদের বক্তৃতা বিবৃতি নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা প্রায়ই ঠাট্টা মসকারা করতেন। বলতেন, ‘তোরাবোরা পাহাড়’ থেকে এলান এসেছে। সেই ঠাট্টাই আজ আওয়ামী লীগের কাছে ফিরে এল।
বিএনপিরর আরেকটি ভয়, ১/১১এর পর ক্ষমতেসীনেরা দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে কিংস পার্টি গঠন করেছিলেন; যদিও সেটি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। এবারেও সে রকম মতলব থাকতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি চাইছে সম্ভাব্য কিংস পার্টি গঠনের আগেই নির্বাচনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করা হোক।
শুরু থেকে ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে বিতর্ক চলে আসছিল। ছাত্রনেতারা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো ১৫ বছর আন্দোলন করেও শেখ হাসিনার সরকারকে ফেলতে পারেনি। তাঁরা পেরেছেন। অন্যদিকে বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলোর দাবি, ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব হাসিনা সরকারের পতনের পটভূমি তৈরি করেছে। ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থান শেষ বাঁশি বাজিয়েছেন।
বিতর্কটি চূড়ান্ত রূপ নেয় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ করা না–করা নিয়ে। ছাত্রনেতারা স্বৈরাচারী শাসনের ‘শেষ প্রতীক’ মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি ও এর সহযাত্রীদের বদ্ধমূল ধারনা, এতে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেবে এবং নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, যা দেশকে মহানৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
রাজনৈতিক মহলে এখন সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হলো নির্বাচন কবে হবে? কীভাবে হবে? সরকারের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা আছে যে সংস্কারের কাজ শেষ করেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সংস্কারের কাজটা কে করবে? অন্তর্বর্তী সরকার না পরবর্তী নির্বাচিত সরকার? আবার সংস্কারের মাত্রা ও পরিধি নিয়েও প্রশ্ন আছে।
সংস্কারের ধরন নিয়েও বিএনপি ও ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদ আছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পুনরাবির্ভাব ঠেকানোর জন্য যেটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেটুটু করা। এর বাইরে গেলেই সমস্যা তৈরি হবে।
অন্যদিকে ছাত্রনেতাদের দাবি, রাজনীতিতে নতুন বন্দোবস্ত করতে সংবিধানসহ সবকিছু আমূল বদলে ফেলতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সক্রিয় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকলেও ছাত্রনেতাদের প্রভাব বেশি। সরকারে রাজনৈতিক দলের কোনো প্রতিনিধি নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন প্রতিনিধি আছেন। জাতীয় নাগরিক কমিটিও সরকারকে নজরদারিতে রাখছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা স্বেচ্ছা পরামর্শের মধ্যেই সীমিত।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির সংকটটা ছিল একমুখী। মার থেকে রক্ষা পাওয়া। এখন সেটি বহুমুখী রূপ নিয়েছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বখরা নিয়ে মারামারি করছেন। অতীতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দখলে থাকা টার্মিনাল, স্টেশন ও হাটবাজার স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা দখল করে নিয়েছেন।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের এই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে’ রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করছে তাদের একদা সহযোগী জামায়াতে ইসলামীও। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপিকেও নানা বিষয়ে ‘কটাক্ষ’ করছেন। তাঁর মতে, জামায়াতই একমাত্র দল, যেই দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে একটিও অভিযোগ আসেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন বাস্তবতায় জামায়াত বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও নতুন হিসাব–নিকাশ করছে। দলের নেতারা ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন, তাদের প্রথম চেষ্টা থাকবে অন্যান্য ইসলামী দলকে নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া। আর সেটা সম্ভব না হলে বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের শক্তি সংহত করবেন। এ কারণে বিএনপি প্রথমে জাতীয় সরকারের আওয়াজ দিলেও হালে জামায়াতের বাইরের দলগুলো নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা করতে চা্ইছে। বিএনপি কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় সহযোগীদের সহায়তা করার জন্য দলীয় নেতা–কর্মীদের নির্দেশনাও দিয়েছে।
বিএনপির নেতারা মনে করেন, জামায়াত নিজেকে যতই গণতান্ত্রিক দাবি করুক না কেন, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিরোধিতা করেছে। তাদের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য ছিল কৌশলগত, আদর্শগত নয়। আবার জামায়াতের মনোভাবটা এমন যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মৌলিক কোনো ফারাক নেই। দুটোই হচ্ছে ‘দখলদারি দল’।
রাজনৈতিক মহলে এখন সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হলো নির্বাচন কবে হবে? কীভাবে হবে? সরকারের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা আছে যে সংস্কারের কাজ শেষ করেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সংস্কারের কাজটা কে করবে? অন্তর্বর্তী সরকার না পরবর্তী নির্বাচিত সরকার? আবার সংস্কারের মাত্রা ও পরিধি নিয়েও প্রশ্ন আছে।
সরকারের ভেতরে একটি অংশ আছে, স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে সংস্কারকাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। অন্যদিকে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সব সংস্কারকাজ শেষ করার দায়িত্ব এই সরকারের নয়। বরং সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থার লক্ষ্যে যেই আইনি সংস্কার প্রয়োজন, সেটুকু করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। চূড়ান্ত সংস্কারের দায়িত্বটি নির্বাচিত সরকারের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত।
অন্যদিকে ছাত্রনেতারা এটিকে দেখছেন ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া হিসেবে। ৭ নভেম্বর ছাত্রদলের নেতারা জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবসের পোস্টার লাগাতে গিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদের মুখে পড়েছে। বিএনপির নেতৃত্ব এটাকে ভালো চোখে দেখছে না। ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা দুই পক্ষের মৈত্রী এখানেই শেষ হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতই দিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ