বিপ্লবের উর্বর ভূমিতে আন্দোলনের ‘শত ফুল’ ফুটছে। প্রতিবিপ্লব ও প্রলোভনের আফিম উৎপন্ন হচ্ছে। সেবনের লক্ষণও স্পষ্ট। ফ্যাসিবাদবিরোধী কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো করে সামাজিক ও অন্যান্য মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের সমর্থকেরা মাথা জাগাতে শুরু করেছেন।
এসব পরিসরে এই ‘নিবারণ চক্রবর্তী’রা এখন সমানে বাণী দেওয়া শুরু করেছেন। তাঁদের উদ্দেশে এই অধমের বিনীত প্রশ্ন, ‘এত দিন কোথায় ছিলে, পথ ভুলে তুমি কি এলে?’ একেবারে নিষ্পাপ অবোধ শিশুর মতো করে কী সরল যুক্তি সামনে এনে বলছেন, বিপ্লববিরোধী বলে কি তাঁরা ‘এই মেঘলামতীর দেশে’ ভাব প্রকাশের সমান সুযোগ পাবেন না?
তাঁদের কথায় মনে হবে, নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসকারীদের বিচার এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে সংস্কার ও নির্বাচনমুখী যাত্রা—এই দুটি পরস্পরবিরোধী। অথচ এই দুটি বিষয় কীভাবে পরস্পরবিরোধী তা বোঝা গেল না।
অলিগার্কি-নির্ভর তার্কিকদের কেউ কেউ ফিসফিস করে এ-ও বলছেন, এত কমিশন-টমিশন গঠন না করে ‘লাভজনক’ কারবার স্বাভাবিকীকরণে জোর দিলে ভালো হতো না! তবে এসব দেশি-বিদেশি দুষ্টচক্রের মন্ত্রণায় অতি বিচলিত হলে, ইউনূসের সরকারের ‘ডিম আগে না মুরগি’ মার্কা একঘেয়ে তর্কেই মধুচন্দ্রিমা পার হয়ে যাবে।
এই সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিজের চরিত্র নির্ধারণ করা, ভবিষ্যতে কোন পথে হাঁটতে হবে তার সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসা এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া শত সমস্যা মোকাবিলা করা।
৫ আগস্ট জনতার ধাওয়ায় ভারতে পালিয়ে যাওয়া তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু পদত্যাগ করেননি, সেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নিল কোন সাংবিধানিক অধিকারে—এই প্রশ্ন পতিত রাজনীতিকেরা জোরেশোরে তুলল বলে।
আর সে রকম পরিস্থিতিতে ‘গেরস্তের একদিন’ (কেউ কেউ ৫ আগস্টকে ‘গেরস্তের একদিন’ বলে থাকেন) ধরা পড়া চোরের মায়ের বড় গলা কি তখন নিচু থাকবে?
৮ আগস্ট ইউনূসের সরকার শপথ গ্রহণের আগেই একটি বিপ্লবের ইশতেহার ঘোষণা করলে এত সব কুতর্ক ওঠার পরিবেশই হয়তো তৈরি হতো না। সরকারও একটি সুস্পষ্ট কর্মপরিধির মধ্যে কাজ করতে পারত।
তাই বলে এই সরকার কেন ও কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছে—এই জিজ্ঞাসা যাঁদের, তাঁরা সম্ভবত তিন তিনটি জোচ্চুরির নির্বাচন, দেড় দশকের দুর্নীতির রাজত্ব, দেশবাসীকে ক্রীতদাস বানানোর প্রকল্প এবং জুলাই-আগস্ট ২০২৪ এবং পূর্ববর্তী হত্যাকাণ্ডে কোনো অপরাধ দেখতে পাচ্ছেন না।
কী করে ইউনূসের সরকারকে ষড়যন্ত্র এবং অপপ্রচারের মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ; পারলে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, সেটিই বিপ্লবে পরাজিত শক্তির প্রবল বাসনা।
এই অসৎ ইচ্ছা ও আচরণই সেই ফ্যাসিবাদী রাজনীতি, যা ভিন্নমত সহ্য করেনি, এখনো করে না। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা দূরে থাকতে চাইলেও এই রাজনীতি তাদেরও ছাড়বে না—সে কথা আওয়ামী আমলের বিরোধী রাজনীতিকদের এখনই ভুলে যাওয়া উচিত হবে না।
এই ধারার বিপরীতে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষাই জন্ম দিয়েছে বিপ্লবের। একটি গণবিরোধী কিন্তু রাজনৈতিক সরকারকে হটানোর রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধের রাজনীতি ক্ষমতায় এনেছে আজকের উপদেষ্টা পরিষদকে।
এখন দেশে গণমুখী রাজনীতির ধারা চালু করা এবং নির্বাচন কমিশন, সংসদ, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করা তাদের অগ্রাধিকারে আছে।
সুশীল কায়দায় অন্য যত বিশেষণই যুক্ত করুন না কেন, প্রফেসর ইউনূসের সরকারও আসলে একটি রাজনৈতিক সরকার; কারণ এই সরকারকে গদিতে বসিয়েছে রাস্তায় নেমে আসা কোটি জনতা। একটি সামষ্টিক জন-অভিপ্রায়ের মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে।
আইনশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, নির্বাচনব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান পুনঃস্থাপন, ন্যায়বিচারের শাসন নিশ্চিতকরণ—এই জাতীয় যেকোনো উদ্যোগেরই রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকবে।
সুতরাং রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা বাদ দিয়ে ক্ষমতা ব্যবহার ও ভবিষ্যতের জন্য দেশীয় ব্যবস্থা ঠিক করার কোনো উপায়ও নেই। বর্তমান নির্দলীয় সরকারের যুগেও রাজনীতির বাইরে গিয়ে অন্য কোনো বাহিনী বা ‘ইনস্ট্রুমেন্ট’ ব্যবহার করে রাষ্ট্র মেরামত করতে চাইলে তার যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।
এমনকি ফ্যাসিবাদী সদ্য সাবেক সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিচারের ইস্যুটিও একটি রাজনৈতিক বিষয়। এর ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তারও শক্তিশালী রাজনৈতিক উত্তর আছে।
তার রাজনৈতিক উত্তর হিসেবে বলছি, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসনিক সহযোগী এবং উসকানিদাতারা অবশ্যই সুষ্ঠু বিচার পাবেন; আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারবেন আদালতে; কিন্তু জনসমক্ষে বা প্রচারযন্ত্রে কি সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কথা বলার বিষয়?
গণতান্ত্রিক জার্মানি ও ইতালির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কি বলা যাবে তাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নেতা যথাক্রমে হিটলার ও মুসোলিনি ‘বড় ভালো লোক ছিল’! মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর মক্কা বিজয়ের পরও কি সেখানে কাফেরদের দৌরাত্ম্য ছিল? নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কি সেখানে বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ শাসন ফিরেছিল?
ইতিহাস একেকজন মানুষকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়, যেভাবে মুহাম্মদ ইউনূস হয়েছেন রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর প্রশাসনও বাংলাদেশেরই নিছক আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারমাত্র নয়।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর প্রতিষ্ঠিত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অস্থায়ী সরকারের দায়িত্ব ছিল একটি সুষ্ঠু, সর্বজনীন সাধারণ নির্বাচন আয়োজন।
১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান এবং ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব সীমাবদ্ধ ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যেই।
একটি বিতর্কিত ও ষড়যন্ত্রমূলক পরিস্থিতির মধ্যে ২০০৭ সালে জেনারেল মইন ইউ আহমেদের সমর্থনে ক্ষমতা গ্রহণ করা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক কিসিমের জরুরি অবস্থার সরকার অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতি ও অন্যান্য সংস্কারে হাত দেয়।
সেই উদ্যোগ কার্যত মাঠে মারা যায় এবং কোনো রকমে ২০০৮ সালের নির্বাচন শেষ করে ও পরবর্তী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দায়মুক্তি নিয়ে কেটে পড়ে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিত ও দায়িত্বের ব্যাপ্তি আলাদা ও কিছুটা জটিল। তবুও জাতির সব সমস্যা ও অমীমাংসিত বিষয় ৫০০ বছরের জন্য নিষ্পত্তি করে দেবে এই সরকার—এমন আশা কোনো সুস্থ মানুষ করতে পারে না।
একই সঙ্গে তাঁর সরকারের ক্ষেত্রে দায়মুক্তির মতো বিব্রতকর ইস্যুটিও আলোচনায় আসবে না যদি ছাত্র-জনতার প্রতিনিধি এবং বিএনপিসহ বিপ্লবের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল ন্যূনতম সাধারণ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে শরিক থাকে।
কিছু মৌলিক ও প্রধান প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুতে জাতীয় সমঝোতা এবং প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের মুসাবিদা করতে রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্তের দরকার হবে। ড. ইউনূসের স্বচ্ছন্দ ব্যক্তিত্ব আর অকপট যুক্তির বক্তৃতাও নতুন প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় হবে।
রাজনীতি যেহেতু একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, তাই দেশপ্রেমী রাজনৈতিক কর্মী ও অংশীজন, সত্যবাদী গণমাধ্যম, খাঁটি অ্যাকটিভিস্ট ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার এগুলো এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে সেটিই হবে ইউনূস সরকারের সার্থক পলিটিক্যাল লিগ্যাসি বা রাজনৈতিক উত্তরাধিকার।
তাই ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঠেকানো, নাগরিকদের ক্ষমতায়ন ও ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, শাসনপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও সামাজিক অনাচার বা দুরাচার রোধ, পরিবেশ বাঁচিয়ে উন্নয়ন ও জনসেবার সংস্কৃতি চালু করা, বিবেকবান জাতি গঠন, বাংলাদেশ স্বপ্নের প্রজ্বালন এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ—এসবই আজকের জাতীয় সংলাপের বিষয় হওয়া উচিত। লিখেছেন: খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক। সূত্র: প্রথম আলো।
আপনার মতামত জানানঃ