হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পর ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যমগুলো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। চ্যানেল ১২-এর ‘মিট দ্য প্রেস’-এ সাংবাদিক আমিত সেগাল ও বেন ক্যাসপিট আরাকের (মধ্যপ্রাচ্যের একধরনের পানীয়) গ্লাস তুলে নাসরুল্লাহর মৃত্যুকে উদ্যাপন করেছেন। বামপন্থীদের টেলিভিশন চ্যানেল ১৩-এর সাংবাদিক পাজ রবিনসন কারমিয়েল শহরে চকলেট বিতরণ করেছেন।
চ্যানেল ১৪-এর প্রধান অনুষ্ঠান ‘দ্য প্যাট্রিয়টস’ উপস্থাপক ইয়িনন মাগালের নেতৃত্বে গান ও উৎসবের মাধ্যমে শুরু করা হয়। সাংবাদিক ইয়নেতে নাদাভ ইয়াল লিখেছেন, ‘(নাসরুল্লাহর) হত্যাকাণ্ডটি একটি আঞ্চলিক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে পড়ে।’ মিডিয়ার এই উল্লাস বাম ও ডানপন্থী উভয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
ডেমোক্র্যাটস পার্টির নেতা ও সাবেক মেরেটজ পার্টির প্রধান ইয়ায়ার গোলান (যিনি একসময় দেশের বামপন্থী মূলধারার রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচিত ছিলেন) এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। তিনি এক্সে লিখেছেন, ‘নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ড একটি বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। মধ্যপ্রাচ্যে এটি নতুন যুগের সূচনা করেছে।’
গাজা থেকে জিম্মিদের ফেরত আনার বিষয়ে ইসরায়েলের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে গভীর বিভক্তি দেখা দিয়েছিল, নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ড সেই বিভক্তিকে অনেকটাই দূর করেছে বলে মনে হচ্ছে।
ইসরায়েলের বিরোধী দলের নেতা ইয়ার লাপিদ লিখেছেন, ‘আমাদের সব শত্রুকে জানিয়ে দাও, যে কেউ ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করবে, মৃত্যুই তার পরিণতি হবে।’
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হাতজেরিম বিমানঘাঁটি থেকে যুদ্ধবিমান উড্ডয়নের ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে বিমানবাহিনীর কমান্ডার ও পাইলটদের মধ্যে রেডিও যোগাযোগের দৃশ্যও ছিল। ভিডিও ক্লিপে বিমানবাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল টোমার বারকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনি এখানে একটি বিজয়ের প্রদর্শনী উপহার দিয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি। এটি ভালো হয়েছে। এটি আমাদের জন্য বিশাল গর্ব।’ তাঁর কথায় এক পাইলট উত্তর দেন, ‘আমরা সবখানে পৌঁছাব, সব শত্রুকে পাকড়াও করব।’
এখানেই ইসরায়েল সন্তুষ্ট হয়নি; ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে হারেৎজ রিপোর্ট করেছে।
সামরিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, গত দুই সপ্তাহের আঘাতের পর হিজবুল্লাহর হতবুদ্ধি হওয়া অবস্থার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা আবার আঘাত হানবে, যাতে ইরান হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত পুনরায় পূরণ করার সুযোগ না পায়।
ইসরায়েল হিজবুল্লাহর কমান্ড সেন্টারের ওপর হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৩০০ মানুষকে হত্যা করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। নিহত এই লোকদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। এরপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করছে। ক্ষমতার মোহে মাতাল ইসরায়েল এখন গভীর ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। হিজবুল্লাহর বর্তমান নেতৃত্বকে ধ্বংস করে তারা পরবর্তী প্রজন্মের যোদ্ধাদের প্রতিহত করতে পারবে না। অন্যদিকে প্রায় তিন হাজান সেনাসদস্যকে পশ্চিম তীরে পাঠানো হয়েছে।
তিনটি ফ্রন্টে যে যুদ্ধ চলছে, তার প্রতিটিতে ইসরায়েল জয়ী হচ্ছে বলে পুরো দেশ মনে করছে।
ইসরায়েল মনে করছে, বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্টতই ইসরায়েলকে নিরস্ত্র করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং এর ফলে তাদের হাতে একটি স্বর্ণালি সুযোগ এসে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত তিনবার বাইডেনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। রাফাহ পুনর্দখল করা, গাজায় হামাসের সঙ্গে অস্ত্রবিরতিতে যাওয়া এবং এখন লেবাননে একটি নতুন যুদ্ধ ফ্রন্ট খোলা নিয়ে তিনি বাইডেনের সঙ্গে বিরোধিতায় জড়িয়েছেন এবং প্রতিবারই সফল হয়েছেন।
নেতানিয়াহু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রক্ষণাত্মক অবস্থানে থাকবেন বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে বাইডেনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং ইসরায়েল তাঁকে সমর্থন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ না করায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞে এখন আর কোনো বাধা নেই। কোনো সীমারেখা নেই। কোনো লাল রেখা নেই।
ইসরায়েলি পাইলট ও ড্রোন অপারেটরদের আর বেসামরিক নাগরিকের জীবন নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। হত্যার সিদ্ধান্ত এখন আঞ্চলিক সেনা কমান্ডারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সমগ্র লেবানন, গাজা ও পশ্চিম তীরের বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
শিশুহত্যার বিষয়ে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা এখন আর নেই। ইসরায়েল একটি জাতিকে অনাহারে রাখতে কোনো বাধার মুখে পড়ছে না। তারা কারাগারে নিয়মিত নির্যাতন ও ধর্ষণ করছে এবং এখন এসব কর্মকাণ্ডকে বিজয় হিসেবে গণ্য করে তারা তা উদ্যাপন করছে।
ইসরায়েল হিজবুল্লাহর কমান্ড সেন্টারের ওপর হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৩০০ মানুষকে হত্যা করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। নিহত এই লোকদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। এরপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করছে।
ক্ষমতার মোহে মাতাল ইসরায়েল এখন গভীর ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। হিজবুল্লাহর বর্তমান নেতৃত্বকে ধ্বংস করে তারা পরবর্তী প্রজন্মের যোদ্ধাদের প্রতিহত করতে পারবে না।
ইসরায়েল জানে না এরপর কে আসছে। এখন পর্যন্ত হিজবুল্লাহ বেসামরিক মানুষকে নিশানা করে আক্রমণ করেনি এবং বড় ধরনের যুদ্ধে জড়াতেও তারা আগ্রহী ছিল না। কিন্তু এখন তাদের সেই সংযম প্রায় নিশ্চিতভাবেই বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। হিজবুল্লাহর কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, তারা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে।
ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে গাজার মতো হামলা চালিয়ে সেখানে আরও একটি অমানবিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল সুরক্ষিত হতে পারবে না; বরং তাদের বেসামরিক লোকের জীবনও অরক্ষিত হয়ে পড়বে। এরপর কী—এ ধরনের সময়ে ইসরায়েল নিজেকে খুব কমই এ প্রশ্ন করে থাকে। তিক্ত এই সংঘাতের ইতিহাস থেকেও তারা কিছু শেখে না।
রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের এই দীর্ঘ ইতিহাসে একটি ঘটনাও পাওয়া যাবে না, যেখানে কোনো জঙ্গি দলের নেতৃত্বকে হত্যার কারণে দলটি বিলীন হয়ে গেছে বা পিছু হটেছে। আজকের বাস্তবতায় হিজবুল্লাহ মনে করছে, তাদের দায়িত্ব হলো পুনরুজ্জীবিত হয়ে প্রতিশোধ নেওয়া।
নিজের শক্তি প্রদর্শন ও অস্ত্রের ঝনঝনানি দিয়ে ইসরায়েল আরব বিশ্বে এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করেছে, যারা একদিন প্রতিশোধ নিতে চাইবেই।
মনে রাখা দরকার, সামরিক শক্তির সীমাবদ্ধতা আছে। ইসরায়েলের জনগণের নিরাপত্তা অর্জনের একমাত্র উপায় হলো আলোচনার টেবিলে ফিরে আসা এবং দখলদারির অবসান ঘটানো। অন্যথায় তারা কেবল প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে যুদ্ধের দরজা খুলে দেবে।
আপনার মতামত জানানঃ